মহারাষ্ট্রের নন্দগাঁও গ্রামের কুসুম সোনাওয়ানে তাঁর গানে ফুটিয়ে তুলেছেন নারী নির্যাতনের সাতকাহন, বেঁধেছেন অকথ্য অত্যাচার সয়ে চলা ক্লান্তির বারোমাস্যা, রেখেছেন ক্ষয়িষ্ণু এক জীবনের কথা নারীজন্মের নামে যা অভিশাপ বই  আর কিছু না তাঁর কাছে

পুণে জেলার মুলশি তালুকের নন্দগাঁও গ্রামের একটি হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় কুসুম সোনাওয়ানের। তিনি চেয়েছিলেন স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করতে, অথচ তাঁর মা তাঁকে পাঠাতেন গরু-ছাগল চরাতে। পড়াশোনা করার সাধ অপূর্ণই রয়ে যায় আজীবন।

১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় কুসুমের; তাঁর কুটুমেরা ওই একই মুলশি তালুকের সাথেসাই গ্রামে থাকতেন। কুসুমের স্বামী মুম্বইয়ে একটি পাথর ভাঙার কলে কাজ করতেন। সেখানে শ্রমিকদের এক হরতালের সময়ে কাজ খোওয়ান তিনি, ফিরে আসেন নিজের গ্রামে, সেখানেই শ্রমিকের কাজে লেগে পড়েন। ১৯৮০ সালে কুসুম গরিব ডোংরি সংগঠনে যোগ দেন। পুণে জেলার যে পাহাড়ি অঞ্চল, সেখানকার গ্রাম আর জনপদগুলির দরিদ্র মানুষজনের জন্য কাজ করে এই সংস্থাটি।

এই অডিওটিতে কুসুম চারটি গান (ওভি) গেয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি সমাজে নারীর যে পরিচয় সেই বিষয়েও কিছু বক্তব্য রেখেছেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের যে শোষণ আর দমন নারীর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তার বিরুদ্ধে নারীর যে প্রতিনিয়ত বিদ্রোহ, সেসব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর কথায়।

এই অডিও ক্লিপটির শুরুতেই ভূমিকা হিসেবে আছে কুসুমের একটি ভাষ্য, তারপর আছে তাঁর গাওয়া একটি ওভি। এরপর এক এক করে যে গান ও ভাষ্যরূপী বক্তব্যগুলি আছে রেকর্ডিংয়ে সেগুলিকেই ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

কুসুম সোনাওয়ানে: হ্যাঁ, এগুলি ওই ধরনেরই গান বটে। কারণ এই সমাজে মহিলারা হাঁপিয়ে ওঠেন সামাজিক দমনের মুখে পড়ে। স্বামীর অত্যাচার আর ভাইয়ের আধিপত্য ক্লান্ত করে দেয় তাঁদের, তখন তাঁরা বুঝতে পারেন যে এই জীবন সত্যিই অর্থহীন। তাঁরা টের পান যে এই জীবনের কোনও মূল্য নেই, এখানে নেই কোনও ভারসাম্য। তাঁরা যখন গান বাঁধেন, তখন এই অনুভূতিগুলোই ওভিতে ফুটে ওঠে:

জ্বলে পুড়ে হোক ছাই, সোমত্ত আঙিনায়, যুবতী দাঁড়ায়েছিল ছোঁয়াবুড়ি এক ঠায়।
তবু কেন ছোঁড়ো কাদা? আঙারে শিকল বাঁধা। শৈশবে শেষ হবে মেয়েবেলা সহজায়।।

(এই গানটি তোরা গাইতে পারবি লো সই...?)

ওভি ১
ছোটবেলা বড় খুশির সময়, ছেলেবেলা মায়াময় — মেয়েবেলা খোঁজে পাপের সাকিন, জঞ্জালে পরিচয়।
একলা কোথাও দাঁড়িয়ে থাকাও মন্দ মোদের দেশে — যাক ডুবে যাক, জ্বলে পুড়ে খাক, নিয়তির অভ্যেসে।।

কুসুমের ভাষ্য: আসলে শেষমেশ একজন মহিলা ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে হয় যে এই যৌবনটাই যত নষ্টের গোড়া, এটাকে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচাটাই শ্রেয়।

ওভি ২
এই যে আমার জলকে চলার রাংচিতা অশরীর। সখি হে দোহাই, একমুঠো ছাই, মান রেখো সেঁজুতির।
দ্যাখো দ্যাখো সই, জঠর কুড়োই, যৌবনে বাঁধি ডোর। ছোঁয়ানি শঙ্খ, মিছে কলঙ্ক, গান্ধারী মাতা মোর।।

কুসুমের ভাষ্য: কোনও মেয়ে খারাপ ব্যবহার করলে, ছন্নছাড়া হয়ে বাঁচলে এমনকি মানুষের দুর্ব্যবহারের শিকার হলেও, সমাজ সেই তাকেই দোষারোপ করবে। সবাই বলবে সে ওমুক কিংবা তমুকের মেয়ে। অর্থাৎ সব দোষ তার মায়ের। দোষ তার সমগ্র পরিবারের হলেও আঙুল তার মায়ের দিকেই তোলা হবে। তাই এমন যৌবনের মুখে ছাই, একে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত। দরকার নেই এমন জীবন ও যৌবনের।

বিঃ দ্রঃ মহাভারতে কৌরবদের মাতা গান্ধারী সেই সকল নারীদের প্রতিনিধি যাঁরা আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে একজন স্ত্রী ও মায়ের ধর্ম পালন করার পরেও সন্তানের দুষ্টকর্মের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন।

ওভি ৩
জানিতাম যদি আগে — জন্মাতে হবে নারীর অঙ্গে আঁটকুড়ানির দাগে —
হতাম রে সখী মায়ের জঠরে তুলসী বেলার গান — চৌকাঠে যেথা আঙুল ঠেকায় অশুচির ভগবান।।

বিঃ দ্রঃ রূপকের দ্বারা গায়িকা এটাই বোঝাতে চাইছেন যে তিনি যদি তুলসী গাছ হতেন তাহলে লোকজন তাঁকে সম্মান দিত, পুজো করতো।

ওভি ৪
কোন গাঁয়ে সই? হতভাগী ওই। জন্ম দিয়েছে শুনি মুখপুড়ি কন্যা।
ভাড়া গোনা সার। পরের দুয়ার। অসুখে সিঁদুর খোঁজে এঁটো ঘরকন্না।।

কুসুমের ভাষ্য: আমি যদি শুরুতেই জানতে পারতাম যে কপালে নারীজীবন আছে তাহলে কোনদিন জন্মাতামই না। কিন্তু এই যে শরীর, এ ভূমিষ্ঠ হয়েছিল একদিন, তারপর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠলো আর শেষে তাকে হাড়ভাঙা খাটুনির মন্দিরে বলিদান দেওয়া হল। যেন পরের বাড়িতে ভাড়া দিয়ে খেটে মরাটাই তার অদৃষ্ট। (নারীর) নিজের কোন মূল্যই নেই।


PHOTO • Bernard Bel

কুসুম সোনাওয়ানে


পরিবেশিকা/গায়িকা: কুসুম সোনাওয়ানে

গ্রাম: নন্দগাঁও

তালুক: মুলশি, কোলওয়ান উপত্যকা

জেলা: পুণে

লিঙ্গ: নারী

জাতি: নব-বৌদ্ধ

বয়স: ৫২

প্রথাগত শিক্ষা: নেই

সন্তান: ২টি মেয়ে ও ২টি ছেলে

পেশা: ধান চাষি

তারিখ: এই গানগুলি ও ভাষ্যসমূহ রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ৫ই অক্টোবর

অডিও রেকর্ডিং, প্রতিলিপি ও ইংরেজিতে মূল অনুবাদটি করেছে পারির জাঁতা পেষাইয়ের গীতি প্রকল্পের দল।

পোস্টার: শ্রেয়া কাত্যায়নী ও সিঞ্চিতা মাজি

হেমা রাইরকার ও গি পইটভাঁর হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পের কথা পড়ুন

বাংলা অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

PARI GSP Team

PARI Grindmill Songs Project Team: Asha Ogale (translation); Bernard Bel (digitisation, database design, development and maintenance); Jitendra Maid (transcription, translation assistance); Namita Waikar (project lead and curation); Rajani Khaladkar (data entry).

Other stories by PARI GSP Team
Editor and Series Editor : Sharmila Joshi

Sharmila Joshi is former Executive Editor, People's Archive of Rural India, and a writer and occasional teacher.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra