ছোট্টো মাংসপিণ্ডটা দিনে দিনে শক্ত হয়ে উঠছে, "একেবারে হাড্ডির মতো," বললেন প্রীতি যাদব।

২০২০ সালের জুলাই নাগাদ প্রীতি হঠাৎই একদিন দেখতে পান যে তাঁর ডান স্তনে মটরকলাইয়ের আকারের একটা মাংসপিণ্ড গজিয়েছে। পাটনা শহরে একটি ক্যান্সার ইনস্টিটিউট আছে, সেখানকার বিশেষজ্ঞরা তাঁকে বলেছিলেন প্রথমে বায়োপ্সি করে তারপর অস্ত্রোপচারের সাহায্যে এই পিণ্ডটা কেটে বাদ দিতে, সেও প্রায় এক বছর হতে চলল আজ।

প্রীতি কিন্তু তারপর থেকে ভুল করেও সেই হাসপাতালের পথ মাড়াননি আর।

"হ্যাঁ হ্যাঁ, সেসব করে নেব ’খন," টালি-ছাওয়া বারান্দায় একটা বাদামি রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বললেন তিনি। তাঁর পারিবারিক ভিটেখানা বেশ বড়সড়, লাগোয়া একটা বাগানও রয়েছে ছোটো ছোটো ফুলগাছে ভরা।

মৃদুভাষী এই মেয়েটির গলার ফিসফিসানি থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। একান্নবর্তী যাদব পরিবার সাম্প্রতিককালেই চার-চারজন সদস্যকে হারিয়েছে ক্যান্সারের কারণে, এবং বিহারের সারন জেলার শোনপুর ব্লকের যে গ্রামটিতে তিনি থাকেন, সেখানে ২০২০ সালের মার্চ মাসে কোভিড-১৯ অতিমারি শুরু হওয়ার আগে মাত্র কয়েকবছরের মধ্যেই একাধিক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। (তাঁর অনুরোধ অনুযায়ী আমরা গ্রামটির নাম এখানে উল্লেখ করছি না, পাশাপাশি তাঁর নামটিও পাল্টে দেওয়া হয়েছে।)

তবে এই মাংসপিণ্ডটা যে কবে কখন অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হবে সেটা ঠিক করাটা ২৪ বছরের প্রীতির একার হাতে নেই। তাঁর জন্য ছেলে দেখার পালা চলছে যে! পাশের গ্রামে একটি ছেলে থাকে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করে, সম্ভবত তাঁর গলাতেই বরমাল্য ঝুলতে চলেছে। "অপারেশনটা তো বিয়েশাদির পরেও করানো যায়, তাই না? তাছাড়া ডাক্তারবাবু তো বলেছেন, একবার বাচ্চাকাচ্চা হলে এই পিণ্ডটা আপনাআপনি মিলিয়েও যেতে পারে," জানালেন তিনি।

তবে এই যে অস্ত্রোপচারের একটা সম্ভাবনা রয়েছে, এবং তাঁদের পরিবারের এতজন সদস্য যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, এসব তথ্য তাঁরা বরপক্ষকে জানাবেন আদৌ? "সেটাই তো বুঝতে পারছি না," অসহায় হয়ে বললেন তিনি। এই গেরোতেই আটকে আছে তাঁর অস্ত্রোপচারের ভবিষ্যৎ।

Preeti Kumari: it’s been over a year since she discovered the growth in her breast, but she has not returned to the hospital
PHOTO • Kavitha Iyer

প্রীতি কুমারী: স্তনে একটি মাংসপিণ্ড আবিষ্কার করার পর থেকে এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে, তিনি কিন্তু একটিবারের জন্যও হাসপাতালে আর ফিরে যাননি

২০১৯ সালে ভূতত্ত্বে বিএসসি পাশ করার পরপরই এই মাংসপিণ্ডটি আবিষ্কার করেন প্রীতি। তারপর একটা গোটা বছর কেটে গেছে, দিনকে দিন নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে ধরেছে তাঁকে। অন্তিম পর্যায়ের বৃক্কের ক্যান্সারে ভুগছিলেন তাঁর বাবা, রোগটা ধরা পড়ার মাত্র কয়েকমাস পরেই ২০১৬ সালের নভেম্বরে মারা যান তিনি। তার ঠিক আগের জানুয়ারিতেই প্রীতি হারিয়েছিলেন হৃদরোগে আক্রান্ত তাঁর মাকে। অথচ হৃদরোগের সবিশেষ চিকিৎসা বন্দোবস্ত আছে এমন বেশ কয়েকটি নামজাদা হাসপাতালে ২০১৩ থেকে নিয়মিত দেখাতেন তিনি। দুজনেরই বয়স ছিল পঞ্চাশের কোঠায়। প্রীতি বলছিলেন, "এক্কেবারে একা হয়ে পড়েছি আমি, মা বেঁচে থাকলে আমার সমস্যাটা নিমেষেই ধরে ফেলত।"

তাঁর মা মারা যাওয়ার ঠিক আগেই যাদব পরিবার জানতে পারে যে কেন তাঁদের পরিবারে ক্যান্সারের হিড়িক পড়ে গেছে এভাবে। নয়াদিল্লির অখিল ভারতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান সংস্থান (এ.আই.আই.এম.এস.) থেকে জানানো হয় যে এর সম্ভাব্য কারণ তাঁদের বাড়ির পানীয় জলের ব্যবস্থাটি। "মায়ের মনে এত কিসের টানাপোড়েন, সেটা জানতে চেয়েছিল ওখানকার ডাক্তারেরা। যেই না আমরা বলেছি যে এত এতজন মারা গেছে ক্যান্সারে তক্ষুনি তাঁরা জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন কোন জল খাই, কোথা থেকে সে জল আসে ইত্যাদি। ওই যে কলটা (হ্যাণ্ডপাম্প) দেখছেন? আজ বহু বছর হতে চলল, তোলার আধাঘন্টার মধ্যেই ওটার জল কেমন যেন হলদেটে হয়ে যায়," জানালেন প্রীতি।

ভারতের যে সাতটি রাজ্যের মাটির তলার পানীয় জলের স্তর বিপজ্জনকভাবে আর্সেনিকের দ্বারা দূষিত, তার মধ্যে অন্যতম বিহার (বাকি ছয়টি রাজ্য যথাক্রমে আসাম, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ)। ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে আর্সেনিকের নিরাপদ মাত্রা যেখানে লিটারপিছু ১০ মাইক্রো গ্রাম, সেখানে কেন্দ্রীয় ভূগর্ভস্থ জল দপ্তর (সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড) জানাচ্ছে (রাজ্য সরকারের অধীনস্থ কিছু সংস্থা এবং বিভিন্ন কর্মীদলের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ২০১০ সালে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন অনুযায়ী) যে বিহারের ১৮টি জেলা জুড়ে ৫৭টি ব্লকে এই মাত্রাটি লিটারপিছু ০.০৫ মিলিগ্রামেরও বেশি – এর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে সারন, অর্থাৎ যে ব্লকটিতে প্রীতি থাকেন সেটিও।

*****

যখন প্রীতির বড়ো দিদি মারা যায় তখন তাঁর বয়স মোটে দুই কি তিন। "শুনেছি সারাক্ষণ পেটের ব্যথায় ছটফট করত দিদি। এ ডাক্তারখানা থেকে সে ডাক্তারখানা চরকিপাক খেয়েছিল বাবা, কোনও লাভ হয়নি তাতে," বলছিলেন তিনি। তারপর থেকে প্রীতির মায়ের মানসিক যন্ত্রণা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছিল কেবল।

তারপর ২০০৯ আর ২০১২ সালে পরপর মারা যান প্রীতির কাকু এবং কাকিমা। একটাই ছাদের নিচে থাকতেন তাঁরা, একান্নবর্তী পরিবার ছিল তো আসলে। দুজনেরই রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল, এবং দুজনকেই ডাক্তারেরা একই কথা বলেছিলেন – চিকিৎসা শুরু করাতে বড্ডো দেরি করে ফেলেছিলেন তাঁরা।

এরপর ২০১৩ সালে পালা আসে তাঁদেরই সন্তানের, অর্থাৎ প্রীতির খুড়তুতো দাদার। ৩৬ বছরের এই যুবক আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বেঁচে থাকার, পাশের বৈশালী জেলার হাজিপুর শহরে চিকিৎসার জন্য গিয়েও ছিলেন, তবে শেষরক্ষা হয়নি। তাঁরও রক্তে ক্যান্সার হয়েছিল।

দীর্ঘ রোগভোগ এবং নাছোড়বান্দা মৃত্যুর কবলে পড়ে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে যাদব পরিবার, ফলত বাড়ির হাজারটা কাজের ভার এসে পড়ে প্রীতির কাঁধে। "মা মাঝে মাঝেই তো মাসের পর মাস অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকত, শেষে একদিন বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ল, তাই ক্লাস ১০ থেকেই বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম সামলাচ্ছি আমি। একটা সময় ছিল যখন প্রতিবছরই হয় কেউ মারা যাচ্ছে, নয়তো রোগভোগ করে যাই-যাই অবস্থা।"

Coping with cancer in Bihar's Saran district
PHOTO • Kavitha Iyer

বিহারের সারন জেলা: ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম

এই যে অস্ত্রোপচারের একটা সম্ভাবনা রয়েছে, এবং তাঁদের পরিবারের এতজন সদস্য যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, এসব তথ্য তাঁরা বরপক্ষকে জানাবেন আদৌ? ‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না,’ অসহায় হয়ে বললেন তিনি। এই গেরোতেই আটকে আছে তাঁর অস্ত্রোপচারের ভবিষ্যৎ

বেশ অনেকখানি জমিজমার মালিক যাদব পরিবার। তাঁদের শুধু যে একান্নবর্তী তা নয়, বেশ বড়সড়ও বটে। তাই এ হেন সংসারের হেঁশেল সামলাতে গিয়ে পড়াশোনায় বিশাল ক্ষতি হয় প্রীতির। তবে তাঁর দুই দাদার মধ্যে একজনের যখন বিয়ে হয়, তখন রান্নাবান্না, ঝাড়পোঁছ, রোগীর সেবা ইত্যাদি থেকে খানিকটা হলেও রেহাই মিলেছিল। তবে বিপদ যেন ছায়ার মতো এঁটেছিল তাঁদের পরিবারের সঙ্গে। প্রীতির এক বৌদি তো আরেকটু হলে মারাই যাচ্ছিলেন বিষাক্ত সাপের কামড়ে। ওদিকে ২০১৯ সালে জমিতে এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাঁর এক দাদা চোখে গুরুতর আঘাত পান, ফলত মাস দুয়েক তাঁর দেখাশোনা করতে হয়েছিল প্রীতিকেই।

মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আস্তে আস্তে অসহায়তায় তলিয়ে যেতে থাকেন তিনি, "সারাক্ষণ মন কেমন করত... অসহ্য টেনশনে কাটছিল দিনগুলো।" তারপর সেই অসহায়তা কাটতে না কাটতেই অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিল এই মাংসপিণ্ড।

গ্রামের আর পাঁচজনের মতো যাদবরাও কলের জল সরাসরি ব্যবহার করতেন। না করতেন পরিশোধন না ছিল ফোটানোর কোন বালাই। জামাকাপড় কাচা, স্নান থেকে শুরু করে খাওয়া বা রান্নাবান্নায় ব্যবহার – যাবতীয় প্রয়োজন তাঁরা দুই দশক পুরোনো একটি ১২০-১৫০ ফুট গভীর নলকূপের জল দিয়েই মেটাতেন বরাবর। "বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমরা খাওয়া আর রান্নার জন্য আর.ও. ফিল্টারের জল ব্যবহার করা শুরু করেছি," জানালেন প্রীতি। ততদিনে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছিল ভূগর্ভস্থ জলে থাকা আর্সেনিকের বিবিধ বিপদের কথা, সারনের মানুষজনও ধীরে ধীরে অবগত হচ্ছিলেন আর্সেনিকের দূষণ ও তার বিষক্রিয়া সম্বন্ধে।

সেই ১৯৫৮ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ.এইচ.ও.) মেনে এসেছে যে আর্সেনিক-মিশ্রিত জল ক্রমাগত ব্যবহার করার ফলে আর্সেনিকোসিস নামে একধরনের বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় – এর থেকে ত্বক, মূত্রথলি, বৃক্ক ও ফুসফুসের ক্যান্সার তথা অন্যান্য রোগ যেমন চামড়ার স্বাভাবিক রঙ নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং তালু ও গোড়ালির ত্বক কালচে শক্ত হয়ে যেতে পারে। ডব্লিউ.এইচ.ও. এটাও বলেছে যে আর্সেনিক-মিশ্রিত জল খাওয়ার সঙ্গে মধুমেহ (ডায়াবেটিস), রক্তচাপ এবং প্রজননগত অসুখের সংযোগ থাকলেও থাকতে পারে।

পাটনায় মহাবীর ক্যান্সার সংস্থান ও গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি বেসরকারি দাতব্য ট্রাস্ট রয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তারা তাদের বহির্বিভাগে চিকিৎসারত ২,০০০ জন অসংহতভাবে নির্বাচিত ক্যান্সার রোগীর থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে জানতে পেরেছে যে কার্সিনোমায় (দেহের আবরণী কোষ থেকে বিকশিত হওয়া একধরনের ক্যান্সার) আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে আর্সেনিকের মাত্রা মারাত্মক রকম বেশি। এর ভিত্তিতে তাঁরা গাঙ্গেয় সমভূমিতে বসবাসকারী জনজাতি সমূহ, ক্যান্সারের প্রকার এবং রক্তে আর্সেনিকের মাত্রার নিরিখে একটি ভূস্থানিক (জিওস্পেশিয়াল) মানচিত্র তৈরি করেন।

"ক্যান্সারে আক্রান্ত যেসব ব্যক্তির রক্তে আর্সেনিকের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত তাঁরা অধিকাংশই গঙ্গার তীরবর্তী জেলাগুলির [এর মধ্যে সারনের নামও রয়েছে] মানুষ। এই যে মাত্রাধিক আর্সেনিকের ঘনত্ব, এর থেকে প্রমাণ হয় যে ক্যান্সার, বিশেষ করে কার্সিনোমার সঙ্গে আর্সেনিকের একটি গভীর সংযোগ রয়েছে," জানালেন ডঃ অরুণ কুমার, ইনি উপরোক্ত ওই গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত একজন বিজ্ঞানী, অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি একাধিক গবেষণা পত্র লিখেছেন এই বিষয়ে।

'Even if I leave for a few days, people will know, it’s a small village. If I go away to Patna for surgery, even for a few days, everybody is going to find out'

'কয়েকদিনের জন্যেও যদি বাড়ির বাইরে থাকি, গাঁয়ের লোকজন ঠিক জানতে পেরে যাবে, আসলে ছোট্টো জায়গা তো। ধরুন পাটনায় অপারেশন করাতে গেলাম, সে দু’একদিনের জন্য হলেও বা, সব্বাই টের পেয়ে যাবে'

"২০১৯ সালে আমাদের গবেষণা কেন্দ্রে ১৫,০০০এরও বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল," ২০২১এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্র থেকে জানা যাচ্ছে। "রোগবিস্তার সংক্রান্ত তথ্য বলছে যে ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশিরভাগই গঙ্গার তীরবর্তী গ্রাম কিংবা শহরের মানুষ। বক্সার, ভোজপুর, সারন, পাটনা, বৈশালী, সমস্তিপুর, মুঙ্গের, বেগুসরাই ও ভাগলপুর – তাঁদের অধিকাংশই এই জেলাগুলিতে বসবাস করেন।"

যদিও প্রীতির পরিবার তথা সারন জেলায় তাঁদের গ্রামের মানুষজন ক্যান্সারের কারণে একাধিক প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তবুও এটা মনে রাখতেই হবে যে একজন যুবতীর পক্ষে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়াটা আজও একটা বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়াটা, বিশেষ করে সে যদি কমবয়সী মেয়ে হয়, সমাজের চোখে কলঙ্ক বিশেষ। ঠিক এটাই বলছিলেন প্রীতির এক দাদা, "গাঁয়ের লোকজন এটা সেটা বলে...আমাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে।"

প্রীতির কথায়, "কয়েকদিনের জন্যেও যদি বাড়ির বাইরে থাকি, গাঁয়ের লোকজন ঠিক জানতে পেরে যাবে, আসলে ছোট্টো জায়গা তো। ধরুন পাটনায় অপারেশন করাতে গেলাম, সে দু’একদিনের জন্য হলেও বা, সব্বাই টের পাবে। আগেই যদি জানতাম যে এই জলেই ক্যান্সার লুকিয়ে আছে…"

ভালোবাসার একটা মানুষ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে মেয়েটা – তবে একটা দুশ্চিন্তা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তাঁর দাম্পত্যসুখের পথে এই মাংসপিণ্ডটা কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তো শেষটায়?

*****

"ও বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে তো বাচ্চাকে?"

পাটনা হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে এই প্রশ্নটি ৫৮ বছরের রামুনি দেবীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, তবে প্রশ্নটি যাঁকে ঘিরে ছিল তিনি কয়েকটি বিছানা পেরিয়ে অন্য একটি বেডে শুয়েছিলেন। ২০১৫ সালের গ্রীষ্মকাল, বছর কুড়ির সেই মহিলার বিয়ে হয়েছিল তার মাস ছয়েক আগে। "আমার তো তাও বুড়ো বয়েসে স্তন কেটে বাদ দিতে হয়েছে। স্তনে ক্যান্সার ধরা পড়েছে বটে, তবে আমার চার চারটে ছেলের প্রত্যেকেই আজ জোয়ান। কিন্তু অল্পবয়সী এই মেয়েগুলোর কী হবে বলুন তো?" স্পষ্টতই উৎকন্ঠিত রামুনি দেবী।

বক্সার জেলার সিমরি ব্লকের বড়কা রাজপুর গ্রামে ৫০ বিঘা জমি আছে যাদব পরিবারের, প্রীতির গ্রাম থেকে এটা আনুমানিক ১৪০ কিমি দূরে। এছাড়াও রাজনৈতিক দিক থেকে যাদব পরিবার যথেষ্ট প্রভাবশালী। রামুনি দেবী তাঁর স্তনের ক্যান্সারের মুখে ছাই দিয়েছেন বছর ছয়েক হতে চলল, আজ তিনি রাজপুর কালান (তাঁর গ্রামটি যে পঞ্চায়েতের অন্তর্গত) পঞ্চায়েতে মুখিয়ার (প্রধান) পদে লড়বেন বলে ভোটে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন। অবশ্য কোভিডের কারণে সমস্ত নির্বাচনই পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবছরের শেষের দিকে হয় কিনা সেটাও দেখার বিষয়।

Ramuni Devi Yadav: 'When a mother gets cancer, every single thing [at home] is affected, nor just the mother’s health'
PHOTO • Kavitha Iyer

রামুনি দেবী যাদব: 'একজন মায়ের ক্যান্সার হলে বাড়ির সব্বাই আতান্তরে পড়ে যায়, একলা সে-ই যে শুধু বিপদে পড়েছে এমন ভাবাটা ভুল'

রামুনি যাদব ভোজপুরী ছাড়া আর কোনও ভাষা জানেন না ঠিকই, তবে তাঁর ছেলেরা এবং স্বামী উমাশঙ্কর চট্ করে তর্জমা করে দেন, তাই অসুবিধা হচ্ছিল না খুব একটা। বড়কা রাজপুরে অনেকেরই ক্যান্সার হয়েছে, জানালেন উমাশঙ্কর। ওদিকে কেন্দ্রীয় ভূগর্ভস্থ জল দপ্তর একটি রিপোর্টে বলছে ১৮টি জেলা জুড়ে যে ৫৭টি ব্লকে মাটির তলার জলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়, তার মধ্যে বক্সার জেলার নাম বিদ্যমান।

সদ্য সদ্য একটা ছোট্টো ট্রাকভর্তি কাঁঠাল আর কয়েক বস্তা মালদার আম পাড়া হয়েছে তাঁদের বাগানে, তারই মাঝে পায়চারি করতে করতে রামুনি জানালেন যে তাঁর অবস্থা যে কতটা সঙ্কটজনক সেটা তাঁর পরিবার তাঁকে তখনই জানায় যখন শেষবারের মতন অস্ত্রোপচার হওয়ার পর রেডিওথেরাপি (তেজস্ক্রিয় পদার্থের দ্বারা চিকিৎসা) শুরু হয়।

পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে যাদব পরিবারের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন থাকেন, তাই তাঁরা প্রথমবার অস্ত্রোপচারের জন্য বারাণসী গিয়েছিলেন। তবে সেই সার্জারিটি সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতিতে করা হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে রামুনি দেবী জানালেন: "প্রথমটায় তো আমরা বুঝতেই পারিনি যে ব্যাপারটা কী, আর এই অজ্ঞতার জন্য বেশ বেগ পেতে হয়েছিল আমাদের।" মাংসপিণ্ডটা কেটে বাদ দেওয়ার ক'দিনের মধ্যেই সেটা আবার গজিয়ে যায়, উপরন্তু যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে থাকেন তিনি। সেই বছরই, অর্থাৎ ২০১৪ সালেই তাঁরা বারাণসীর সেই ডাক্তারখানাটিতে ফিরে যান, এবং সেই ভুল অপারেশনটি দ্বিতীয়বারের জন্য করা হয়।

"ব্যান্ডেজ পাল্টাতে আমাদের গাঁয়ের ডাক্তারখানায় গিয়েছিলাম তারপর। যেতে না যেতেই সেখানকার ডাক্তারবাবু বলে উঠলেন যে ঘা-টা দেখে তো গতিক সুবিধার ঠেকছে না," বলছিলেন উমাশঙ্কর। আরও দুটো হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা, শেষে জনৈক সহৃদয় ব্যক্তি তাঁদের মহাবীর ক্যান্সার সংস্থানের খোঁজ দেন ২০১৫ সালে।

মাসের পর মাস এভাবে গ্রাম ছেড়ে এ হাসপাতাল থেকে সে হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকায় তাঁদের গৃহস্থালি ঘিরে থাকা জীবনটি কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে উঠেছিল। "একজন মায়ের ক্যান্সার হলে [বাড়ির] সব্বাই আতান্তরে পড়ে যায়, একলা সে-ই যে শুধু বিপদে পড়েছে এমনটা ভাববেন না যেন," বলছিলেন রামুনি দেবী, "তখনও আমার ছোটো তিনটে ছেলের বিয়েথা হয়নি, তাই বাড়ির সবকিছু সামলাতে গিয়ে বড়ো বৌমা হিমসিম খাচ্ছিল।"

চামড়ার রোগে লাগাতার ভুগেছেন তাঁর ছেলেরাও। গ্রামে বছর পঁচিশেক পুরোনো ১০০-১৫০ ফুট গভীর যে নলকূপটি রয়েছে, সেটাকেই দুষছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে। একের পর এক চিকিৎসা চলতে থাকে রামুনির – কেমোথেরাপি, অস্ত্রোপচার, রেডিওথেরাপি। ওদিকে বাড়ির সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছিল দিনকে দিন। এক ছেলে কাজ করতেন সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীতে (বি.এস.এফ.), তাই বক্সারে টানা থাকতে পারতেন না। আরেক ছেলে পাশের গ্রামে স্কুলশিক্ষক, তাই দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকেন। এছাড়াও দেখভাল করার জন্য তাঁদের সেই ৫০ একর খেত-খামার তো ছিলোই।

"শেষবার অপারেশন হওয়ার পর দেখলাম যে একটি সদ্য সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ে এসেছে আমার ওয়ার্ডে, বড্ডো অল্প বয়স। আমি সটান চলে গেলাম তার কাছে, গিয়ে নিজের ক্ষতচিহ্নটা দেখিয়ে বললাম একদম চিন্তা না করতে। ওরও স্তনে ক্যান্সার হয়েছিল। তবে দেখলাম যে বরটা খুব ভালো, মোটে ক'মাস হল বিয়েশাদি হয়েছে বটে, কিন্তু বউটার যত্নআত্তি করে খুব। ডাক্তারবাবু পরে জানিয়েছিলেন, বাচ্চাকাচ্চা হলে ও নিশ্চিন্তে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে। এটা শুনে সে যে কী খুশিই না হয়েছিলাম তা বলে বোঝাতে পারব না আপনাকে," বলছিলেন রামুনি।

Ramuni Devi and Umashankar Yadav at the filtration plant on their farmland; shops selling RO-purified water have also sprung up
PHOTO • Kavitha Iyer

নিজেদের জমিতে একটি জল পরিশোধক যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রামুনি দেবী ও উমাশঙ্কর যাদব; আর.ও. পরিশোধিত জল পাওয়া যায় এমন অজস্র দোকান গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো

তাঁর ছেলে শিবাজিৎ জানালেন যে বড়কা রাজপুরের জল মারাত্মক রকম দূষিত। "পানীয় জল আর স্বাস্থ্যের মধ্যে যে এমনতর যোগ রয়েছে সেটা মা অসুস্থ হওয়ার আগে বুঝিনি। তবে হ্যাঁ, এখানকার জলের রঙটা কেমন যেন একটা, খুবই বিচ্ছিরি। ২০০৭ অবধি তো সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু তারপর দেখলাম যে আস্তে আস্তে জলটা কেমন যেন হলদেটে হয়ে যাচ্ছে। এখন এই জল দিয়ে আমরা কেবল চানটান আর ওই কাচাকাচি করি," জানালেন তিনি।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কয়েকটি সংস্থার লোকজন একটি জল পরিশোধক যন্ত্র বসিয়ে দিয়ে গেছে (যাদবদের জমিতে) তাঁদের গ্রামে, এখানকার ২৫০টি পরিবার রান্নাবান্না আর খাওয়ার জন্য এই জলই ব্যবহার করে এখন। তবে বেশ কয়েকটি গবেষণা পত্রে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে সেই ১৯৯৯ সাল থেকেই এখানকার জলে দূষণ ধরা পড়েছিল।

তবে এই পরিশোধক যন্ত্রটি যে খুব একটা কাজে লাগে তা নয়। গ্রামের মানুষের বক্তব্য, এর থেকে যে জলটা বেরোয় সেটা গ্রীষ্মকালে এতটাই গরম হয়ে যায় যে আর ব্যবহার করা যায় না। ফলত আশেপাশের গ্রামে এমন অসংখ্য দোকান গজিয়ে উঠেছে যেখানে ২০ লিটারের পাত্রে (জার) পরিশোধিত জল কিনতে পাওয়া যায়, এক একটা জারের দাম ২০-৩০ টাকা, বলছিলেন শিবাজিৎ। সেই সঙ্গে এটাও জানালেন যে সেই জল আদৌ আর্সেনিক-মুক্ত কিনা সেটা বুক ঠুকে কেউই বলতে পারবে না।

উত্তর তথা পূর্ব ভারতের বহু সংখ্যক নদীতীরবর্তী অঞ্চল আর্সেনিকের দ্বারা দূষিত এবং এখানকার নদীগুলির উৎস হিমালয় পর্বতমালা। এই প্রসঙ্গে একাধিক গবেষণা পত্র বলছে যে আর্সেনোপাইরাইট নামে এক প্রকারের নির্বিষ আকরের থেকে অক্সিডেশনের কারণে মাটির তলার প্রাকৃতিক জলাধারগুলিতে আর্সেনিক মিশে যায় — ফলত এই যে বিপজ্জনকভাবে দূষিত গাঙ্গেয়ভূমি, তার পিছনে ভূতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। আর যেহেতু কিছু কিছু গ্রামে সেচের নামে মাটির নিচে থাকা জলের স্তরকে মাত্রাতিরিক্ত শুষে নেওয়া হয়েছে, তাই সেই অঞ্চলগুলিতে আর্সেনিকের মাত্রা হুহু করে বেড়ে গেছে — বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। অবশ্য এটা ছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে কয়েকটি, যথাক্রমে:

"আমাদের মতে এর পাশাপাশি পাললিক আর্সেনিকের আরও বেশ কয়েকটি উৎস রয়েছে। যেমন রাজমহল অববাহিকায় গন্ডোয়ানার কয়লার স্তর, যেখানে ২০০ পিপিএম (পার্টস্ পার মিলিয়ন, অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখ ভাগে এক ভাগ) আর্সেনিক পাওয়া যায়; দার্জিলিঙের হিমালয়ের মাটিতে খাপছাড়া ভাবে জমাট বেঁধে থাকা সালফাইডের আকর, যার মধ্যে ০.৮% আর্সেনিক; এছাড়াও গাঙ্গেয় প্রবাহ প্রণালীর উৎসমুখে আরও বেশ কয়েকটি উৎস রয়েছে আর্সেনিকের," ১৯৯৯ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে এমনটাই লিখেছিলেন এস. কে. আচার্য (ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ, অর্থাৎ জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরত ছিলেন তিনি) তথা কয়েকজন সহগবেষক।

কুয়ো বা নলকূপের গভীরতা যদি খুবই অল্প কিংবা খুব বেশি হয় তাহলে আর্সেনিকের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম থাকে জলে, অথচ গভীরতা যদি মাঝারি মাপের হয়, অর্থাৎ ৮০ থেকে ২০০ ফুটের মধ্যে, তাহলেই দেখা যায় যে জলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক মিশ্রিত রয়েছে – একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্যটি। বিশদ পর্যবেক্ষণের জন্য তাঁরা যে গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে জলের নমুনা পরীক্ষা করেছেন, সেখানকার মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে উপরোক্ত তথ্যটি খাপে খাপে মিলে যায় – জানালেন ডঃ কুমার। সে বৃষ্টির জল হোক কিংবা অগভীর কুয়ো, তাতে আর্সেনিকের দেখা মেলে না সহজে। অথচ নলকূপের যে জল বেশিরভাগ গৃহস্থালিতেই গরমকালের মাসগুলোতে ব্যবহার করা হয়, সেটা ঘোলাটে।

*****

Kiran Devi, who lost her husband in 2016, has hardened and discoloured spots on her palms, a sign of arsenic poisoning. 'I know it’s the water...' she says
PHOTO • Kavitha Iyer
Kiran Devi, who lost her husband in 2016, has hardened and discoloured spots on her palms, a sign of arsenic poisoning. 'I know it’s the water...' she says
PHOTO • Kavitha Iyer

২০১৬ সালে কিরণ দেবীর স্বামী মারা যান, আজ আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর হাতের তালুতে ফুটে উঠেছে শক্ত কিছু চাকা চাকা কালচে দাগ। 'এটা ওই জলের থেকেই হয়েছে, হাড়ে হাড়ে জানি আমি...' জানালেন তিনি

বক্সার জেলায় বড়কা রাজপুর থেকে কিলোমিটার চারেক দূরত্বে রয়েছে তিলক রাই কা হাট্টা নামক ছোট্টো একটি গ্রাম। আনুমানিক ৩৪০টি পরিবারের বাস এখানে, অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষক। বাড়ির বাইরে যে হ্যাণ্ডপাম্পগুলি রয়েছে তার জল বিদঘুটে ঘোলাটে।

২০১৩-১৪ নাগাদ এখানকার জল পরীক্ষা করে দেখা যায় যে আর্সেনিকের মাত্রা মারাত্মক রকমের বেশি, বিশেষ করে তিলক রাই কা হাট্টার পশ্চিম দিকটায়। এই পরীক্ষাটির দ্বায়িত্বে ছিলো মহাবীর ক্যান্সার সংস্থান, জানালেন প্রধান গবেষক ডঃ অরুণ কুমার। আর্সেনিকোসিসের মূল উপসর্গগুলি ফুটে উঠেছে গ্রামবাসীদের শরীরে: তাঁদের ২৪ শতাংশের তালু এবং পায়ের পাতায় রয়েছে হাইপারকেরাটোসিসের চিহ্ন (চাকা চাকা দাগ, চামড়া যেখানে শক্ত কালচে হয়ে যায়), ৩১ শতাংশের ত্বকের রঙ পাল্টে গেছে (মেলানোসিস), ৫৭ শতাংশ যকৃতের রোগে ভুগছেন, গাসট্রাইটিসে আক্রান্ত ৮৬ শতাংশ, এবং মহিলাদের মধ্যে ৯ শতাংশের মাসিক ঋতুচক্রে দেখা গেছে অনিয়ম।

এই গ্রামের বাকি বাড়িগুলোর থেকে খানিকটা তফাতে মাটি দিয়ে গাঁথা ইটের কয়েকটা কুঁড়েঘর রয়েছে — পাড়াটির নাম বিচ্ছু কা ডেরা। কিরণ দেবীর স্বামী এখানেই থাকতেন। "মানুষটা পেটের ব্যাথায় কাতরাতো কাটা ছাগলের মতন, শেষে ২০১৬ সালে চলেই গেল," বলছিলেন তিনি। পরিবারের লোকজন তাঁকে সিমরি আর বক্সারের একাধিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, একেকজন ডাক্তার একেক রকমের নিদান দেন রোগের। "কেউ বলল যক্ষ্মা (টিউবারকুলোসিস) হয়েছে, কেউ বলল লিভার ক্যান্সার," স্পষ্টত হতাশা ফুটে উঠছিল বছর পঞ্চাশেকের কিরণের গলায়। তাঁদের ছোট্টো একফালি একটা জমি আছে বটে, তবে তাঁর স্বামীর রুজিরুটির প্রধান অবলম্বন ছিল দিনমজুরি।

২০১৮ সাল থেকে কিরণ দেবীর হাতের তালুতে ফুটে উঠেছে চাকা চাকা শক্ত কালচে দাগ, আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার স্পষ্ট লক্ষণ। "হাড়ে হাড়ে জানি এসব ওই জল থেকেই হচ্ছে, কিন্তু নিজের বাড়ির কল না ব্যবহার করে অন্য কোথায় জল খুঁজে মরি বলুন তো?" বাড়ির ঠিক বাইরেই একচিলতে জমিতে জাবর কাটছিল গোবেচারা একখানা বলদ, তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই হ্যাণ্ডপাম্পটি।

তিনি জানালেন যে জলের মান সবচাইতে খারাপ থাকে শুখার সময়, অর্থাৎ বর্ষা পেরিয়ে গেলে। দেখে মনে হবে যেন পাতলা করে বানানো দুধ-চা। "দুমুঠো ভাত জোগাড় করতেই জান ঢিলা হয়ে যাচ্ছে, পাটনা গিয়ে ডাক্তারবদ্যি দেখাবই বা কী করে, আর পরীক্ষা-টরীক্ষা ওসব করাবই বা কেমন করে?" জিজ্ঞেস করলেন তিনি। তাঁর হাতের চেটো দুটো সারাক্ষণ চুলকোয়, আর কাপড় কাচার সাবান ছুঁলে বা দিনের শেষে গোয়ালে ঢুকে গোবর কুড়োতে গেলেই এই চুলকুনিটা জ্বালায় পরিণত হয়।

রামুনি বলেছিলেন, "মেয়েমানুষ আর জলের মধ্যে নাড়ির যোগ রয়েছে, কারণ গেরস্থ বাড়ির মধ্যমণি তো এরা দুজনেই। তাই জল যদি এমন বিষাক্ত হয়, তাহলে সব্বার আগে জ্বলেপুড়ে মরবে মেয়েরাই।" উমাশঙ্কর সেই সঙ্গে বলেছিলেন কেমন করে ক্যান্সার সামাজিক কলঙ্কে পরিণত হয়, আর তার ফলে বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা, যতক্ষণে ডাক্তারের কাছে যান ততক্ষণে বড্ডো বেশি দেরি হয়ে যায়।

তাঁরা এটাও বললেন যে গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি থেকে জলের মান সম্পর্কে একটি প্রচার অভিযান চালানো হয়েছিল যখন জানা যায় যে রামুনি দেবী স্তনের ক্যান্সারে আক্রান্ত। ভোটে জিতে মুখিয়া হলে তিনি এই লড়াই আরও জোরদার করবেন, এই ব্যাপারে রামুনির সংকল্প অতি দৃঢ়। "সবার পক্ষে তো আর বাড়িতে একটা করে আর.ও. যন্ত্র কেনা সম্ভব নয়। তাছাড়াও সব মহিলারা হুট করে হাসপাতালে যেতেও পারেন না। যতক্ষণ না এই সমস্যার নতুন কোনও সমাধান বের করতে পারছি ততক্ষণ আমরা হাল ছাড়ব না।"

পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।

নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Kavitha Iyer

Kavitha Iyer has been a journalist for 20 years. She is the author of ‘Landscapes Of Loss: The Story Of An Indian Drought’ (HarperCollins, 2021).

Other stories by Kavitha Iyer
Illustration : Priyanka Borar

Priyanka Borar is a new media artist experimenting with technology to discover new forms of meaning and expression. She likes to design experiences for learning and play. As much as she enjoys juggling with interactive media she feels at home with the traditional pen and paper.

Other stories by Priyanka Borar
Editor and Series Editor : Sharmila Joshi

Sharmila Joshi is former Executive Editor, People's Archive of Rural India, and a writer and occasional teacher.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra