“ইল্লাল্লাহ্ কি শরাব নজর সে পিলা দিয়া,
ম্যাঁ এক গুনাহ্'গার থা, সুফি বানা দিয়া।
সূরত মেঁ মেরা আ গয়ি সূরত ফকির কি,
ইয়েহ্ নজর মেরে পীর কি, ইয়েহ নজর মেরে পীর কি...”
[দু'চোখ ভরে আল্লাহ্র সুরা পান সে করাইলা
ছিলেম ফাজির, আমারে সাঁই সুফি বানাইলা।
ফকিরের চেহারা সাঁই আইলা শেষে মোর চেহারায়,
এ আমার পীরের নজর, পীরের নজর এটাই এটাই...]
কব্জিতে বাঁধা ঘুঙুর, সদ্যোজাত শিশুর মতো কোলে রাখা ঢোল, এসব বাজিয়েই পুণের কাছে একটি দরগায় বসে গাইছিলেন এক কাওয়াল।
সুস্পষ্ট গমগমে কণ্ঠ কোনও মাইক্রোফোন ছাড়াই সজোরে ধাক্কা খাচ্ছে উপরের গম্বুজে। না আছে পাশে ধুয়ো তোলার কেউ, না আছে সামনে কোনও শ্রোতার ভিড়, একাই গেয়ে চলেছেন তিনি।
একটা কাওয়ালি শেষ হতে না হতেই আরেকটা জুড়ছিলেন। কেবল যোহর (দ্বিপ্রহর) আর মাগরিবের (সন্ধ্যাকালীন) নামাজ আদায়ের সময় জিরোচ্ছিলেন কাওয়াল, কারণ সালাতের সময়ে গানবাজনা করা অনুচিত বলে ধরা হয়। নামাজ ফুরোতে না ফুরোতেই আবারও গেয়ে উঠলেন তিনি, চলল সেই রাত ৮টা পর্যন্ত।
“আমি আমজাদ। আমজাদ মুরাদ গোণ্ড। আমরা জাতিতে রাজগোণ্ড। আদিবাসী,” এই বলে নিজের পরিচয় দিলেন কাওয়াল। নামে আর চেহারায় মুসলিম, জন্মসূত্রে আদিবাসী, তিনি আরও জানাচ্ছেন, “কাওয়ালি আমাদের পেশা!”
পান চিবোতে চিবোতে কথা বলছিলেন আমজাদ সাহেব, “এমন একটা লোক খুঁজে দিন যার কাওয়ালি ভাল্লাগে না! এ এমনই একটা শিল্প যা সক্কলে ভালোবাসে।” মুখের পানটা খতম হতেই তাঁর নেশা ও পেশা কাওয়ালির বিষয়ে বলে উঠলেন, “পাবলিক কো খুশ করনে কা। বাস্ [মানুষকে খুশি করাটাই আসল কথা, ব্যাস্]!”
“পাওঁ মেঁ বেড়ি, হাথোঁ মেঁ কঢ়া রেহনে দো, উসকো সরকার কি চৌখট পে পড়া রেহনে দো... [দু'পায়ের বেড়ি-জোড়া, দু'হাতের বালা-তোড়া থাক তবে থাক... সাহেবের চৌকাঠে, যে আজ এসেছে জুটে, থাক সেও থাক],” সুরটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে, মনে হচ্ছে জনপ্রিয় কোনও একটা হিন্দি সিনেমার গান থেকে নেওয়া।
তবে দরগায় আসা মানুষজন কিন্তু কাওয়ালিতে এরকম বলিউডি সুর আরোপ করায় বিরক্ত হচ্ছেন না, বরং আমজাদ সাহেবের গানে মজে কেউ ১০ টাকা, কেউ ২০ টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। মাজারে চাদর চড়িয়ে পরমপূজ্য সন্তের দোয়া চাইতে আসা ভক্তদের তিলগুল (তিল ও গুড়) বিতরণ করছেন তদারককারীরা। ভক্ত-সওয়ালিদের ঘাড়ে-পিঠে ময়ূর পালক ঝেড়ে ইবলিশের বদনজর তাড়াচ্ছেন এক মুজাওর। পীরের উদ্দেশ্যে নজরানা স্বরূপ টাকাপয়সা দিয়ে যাচ্ছে লোকে, অল্প একটু বকশিস কাওয়াল সাহেবও পাচ্ছেন।
ধনবানদের নিত্য সমাগম এই দরগায়, আমজাদ মুরাদ গোণ্ড জানালেন। আসার পথে অসংখ্য ছোটো ছোটো গুমটি পড়বে, সব জায়গাতেই দেখবেন নজর নিয়াজের জন্য চাদর আর ওড়না বিক্রি হচ্ছে। উপাসনাস্থল মানেই কত মানুষের পেটের জোগান আর কর্মসংস্থান।
হজরত পীর কমর আলি দরবেশ ভেদাভেদ করেন না। দরগার সিঁড়িতে দেখবেন ভিক্ষে চেয়ে ফিরছেন এক ফকির, তাঁরই পাশে দুটো পয়সা আর দয়ার তরে হাত বাড়িয়ে আছে কত প্রতিবন্ধী মানুষ। এক হিন্দু মহিলা নিয়মিত আসেন এ মাজারে, গায়ে থাকে মহারাষ্ট্রের প্রথাগত নওভরি বা নয় গজের শাড়ি। মনে মনে হজরত কমর আলি দরবেশের আশীর্বাদ অনুভব করতে পারেন তিনি। প্রতিবন্ধী, অনাথ, কাওয়াল — এখানে সক্কলে পীর সাহেবের কৃপার পাত্র।
আমজাদ মুরাদ গোণ্ড ভিখিরি নন মোটেই। তিনি একজন শিল্পী। সকাল ১১টায় আসেন, দরগার সামনে জুৎসই জায়গা দেখে নিজের 'মঞ্চ' বেঁধে বসে পড়েন। ধীরে ধীরে আসতে থাকে সওয়ালির দল। মাজারের চারধারে সাদা মর্মর ও কালো গ্রানাইটের মেঝে, দুপুর হতে না হতেই তেতে আগুন হয়ে যায়। ফোসকা-পড়া আঁচ থেকে বাঁচতে পড়ি কি মরি হয়ে দৌড় লাগান ভক্তরা। সওয়ালিদের মধ্যে মুসলিমের চাইতে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি।
তবে পীরের কবরের কাছে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ। তাই মুসলিম মহিলা-সহ অনেকেই বারান্দায় বসে বসে চোখ বন্ধ করে কুরআনের আয়াত পাঠ করতে থাকেন। তাঁদের পাশেই দেখলাম কাছাকাছি গাঁ থেকে আসা এক হিন্দু মহিলা, যাঁর উপর পীরের রূহ ভর করেছে। লোকের মুখে শুনলাম, “পীরাচা ওয়ারা [পীরের আত্মা]।”
উপাসকদের বিশ্বাস, বিষাক্ত সাপখোপ বা কাঁকড়াবিছে কামড়ালে মাজারে রাখা চিরাগের তেল বিষহর মহৌষধির কাজ করে। এ বিশ্বাসের শিকড় সেই যুগে গাড়া আছে যখন বিষ-টিষের কোনও অ্যান্টিভেনম হত না। হ্যাঁ, আজ হয়তো ডাক্তারবদ্যি আছে, চিকিৎসাশাস্ত্রে বিষের নিদানও দেওয়া রয়েছে, তবে অনেকের ক্ষেত্রেই এসব কিছু ব্যবস্থা করার ট্যাঁকের জোর নেই। এছাড়া আরও বিভিন্ন রকমের দুশ্চিন্তার তাড়া খেয়ে আসে লোকে — সন্তানহীন নারী, শাশুড়ি বা বরের হাতে নির্যাতিতা মেয়েরা। সঙ্গে তাঁরাও আছেন যাঁদের ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছে।
মানসিক ব্যাধিগ্রস্তরাও পীরের ছোঁয়া পেতে আসেন এ দরগায়। দোয়ার উমিদে মাথা কুটতে থাকেন তাঁরা, আর সুর-তাল-ছন্দে তাঁদের প্রার্থনাকে কথায় বেঁধে কাওয়ালি গাইতে থাকেন আমজাদ সাহেব। দোয়ার আর্তিতে আবারও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম।
তিনি কি একটিবারের জন্য গানবাজনা বন্ধ করেন? গলা ধরে যায় না? ফুসফুস তো নয়, যেন জোড়া হারমোনিয়াম। দুটো গানের মাঝে আমজাদ সাহেব একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন দেখেই তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার ফিকিরে এগিয়ে গেলাম। “মেরে কু কুছ দেন পড়েগা ক্যায়া? [আমায় কিছু 'দিতে-টিতে' হবে নাকি?],” প্রশ্নের সঙ্গে দুটো আঙুল ঘষে টাকাপয়সার ইঙ্গিত করলেন আমজাদ সাহেব। আমার আর বলার মতো কিছু রইল না। তাই আবারও তাঁর কাছে দুদণ্ড সময় চেয়ে আমজাদ মুরাদ গোণ্ডের গান শুনতে লাগলাম।
কাওয়ালি বড়ো রূহানি — এ সরাসরি আত্মাকে ছুঁয়ে যায়। সুফি পরম্পরা এর সঙ্গে হকিকা বা অনন্তের যোগ খুঁজে পেয়েছে। টিভির রিয়েলিটি শোয়ে যা দেখা যায় তা রূহানি নয়, বরং রূমানি বা রোমান্টিক। এ দুটো ছাড়াও তৃতীয় একটি প্রকার আছে, আমরা তাকে খানাবাদোশি বলতে পারি। আমজাদ মুরাদের মতন যাঁরা পেটের দায়ে ভবঘুরে হন, খানাবাদোশি তাঁদেরই ছুঁয়ে আছে।
আকাশে বাতাসে তরঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমজাদ মুরাদের কণ্ঠ।
তাজদার-এ-হরম্, হো নিগাহ্-এ-করম্
হম্ গরিবোঁ কে দিন ভি সঁওর
যায়েঙ্গে...
আপকে দর্ সে খালি আগর যায়েঙ্গে
[মক্কার রাজা, মদিনার রাজা,
কৃপার দৃষ্টি বর্ষাও খ্বাজা!
আমাদের মতন কাঙালের দিনও
হয়ে যাবে উদ্ধার...
তোমার দুয়ারে আল্লাহ গো
মোরা যাই যদি একবার।]
আমজাদ গোণ্ড গাইছিলেন বলেই বোধহয় শেষের পংক্তির অর্থটা আরও নাব্যতা পাচ্ছিল। তাঁর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা আগের চাইতে আরও প্রবল ভাবে চাগাড় দিয়ে উঠল। পাছে তিনি বিরক্ত হন, তাই পরদিন তাঁর খানিকটা সময় নেব বলে আবারও মাজারের দিকে হেঁটে গেলাম। পীর কমর আলি দরবেশের ইতিহাস জানতে জানতেই কেটে গেল দিনটা।
দরগার সামনে জুৎসই জায়গা দেখে নিজের 'মঞ্চ' বেঁধে বসে পড়েন আমজাদ গোণ্ড। ধীরে ধীরে আসতে থাকেন সওয়ালিরা, অবশ্য মুসলিমের চাইতে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি
*****
শোনা যায় কোনও এককালে পুণে থেকে ২৫ কিলোমিটার দূর, সিংগড় কেল্লার পাদদেশে খেড় শিবপুর নামের একটি ছোট্ট গাঁয়ে এসে হাজির হয়েছিলেন হজরত কমর আলি। এদিকে গাঁয়ের লোকজন তো এক জ্বিনের পাল্লায় পড়ে অতিষ্ঠ। তাঁরা হজরত কমর আলির কাছে গিয়ে মদত চান। সন্ত সাহেব সেই জ্বিনটাকে একখান পাথরে বন্দি করে অভিশাপ দেন: “তা কেয়ামত, মেরে নাম সে লোগ তুঝে উঠা উঠা কে পটকতে রহেঙ্গে, তু লোগোঁ কো পরেশান কিয়া করতা থা, অব্ জো সওয়ালি মেরে দরবার মেঁ আয়েঙ্গে উওহ তুঝে মেরে নাম সে পটকেঙ্গে [কেয়ামতের দিন অবধি লোকে আমার নাম নিয়ে তোকে তুলে তুলে আছাড় মারবে, তুই ব্যাটা এদ্দিন মানুষকে জ্বালিয়ে খেতিস, এবার থেকে যে যে ভক্ত আমার দরবারে আসবে, তারা সব্বাই আমার নাম নিয়ে তোকে তুলে আছাড় মারবে]।”
দরগার সামনে যে পাথরটা রাখা আছে সেটার ওজন ৯০ কেজিরও বেশি। জনা এগারোর দল মিলে সেটা এক আঙুলে তুলে গলা ফাটিয়ে 'ইয়া কমর আলি দরবেশ' আওড়াতে আওড়াতে আছাড় মারে সজোরে!
মাজার তো গ্রামে গ্রামে রয়েছে, তবে খেড় শিবপুরের এই দরগার মতন এত ভিড় সচরাচর চোখে পড়ে না। ওজনদার এই আজব পাথরটার চমক অনেককেই টেনে আনে। সেটা ভালোই, ভিড় না জমলে আমজাদ মুরাদ গোণ্ডের মতো মানুষের রোজগারটা কমে যেত। সওয়ালিরা আরও একটা জিনিস বিশ্বাস করেন: আউলিয়া সাহেবের দোয়া মিললে সন্তানহীনের কোল আলো করে বাচ্চা জন্মায়। “আমরা জড়িবুটি দিয়েও বন্ধ্যাত্ব সারাই,” আমজাদ সাহেব জানালেন।
*****
মাজার চত্বরে একখান মসজিদও আছে, পাশেই তার অযুখানা। আমজাদ গোণ্ড সর্বাগ্রে সেখানে গিয়ে ভালো করে পুরোদস্তুর সাফসুতরো হলেন, তারপর খোঁপা বেঁধে, কমলা রঙের ফেজটুপি চড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন আমার সঙ্গে, “প্রতিমাসে এখানে আসি, অন্তত একহপ্তা তো থাকিই।” শৈশবেও নিয়মিত আসতেন তিনি, আব্বার হাত ধরে। “তখন বোধহয় ১০-১৫ বছর বয়স হবে আমার, আব্বা যখন প্রথম এখানে এনেছিল আমায়। আজ আমার বয়স ৩০ পেরিয়েছে, মাঝে মাঝে আমিও আমার ছেলেকে নিয়ে আসি এখানে।”
দরগায় ভূগর্ভস্থ চাতালে দরবেশি বেরাদরির কয়েকজন মাদুর বিছিয়ে ঘুমোচ্ছেন। আমজাদ সাহেবের বোঁচকাটাও দেখলাম দেওয়ালের কাছে রাখা আছে। সেটা খুলে একখানা মাদুর বার করে শানের উপর পাতলেন। জানতে পারলাম, তাঁর বাড়ি জলগাঁও জেলার পাচোরা শহরের গোণ্ড বস্তিতে।
না হিন্দু, না মুসলিম — এসব তকমা এঁটে নিজের পরিচয় দিতে নারাজ আমজাদ মুরাদ গোণ্ড। তাঁর পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করলাম, জবাব এল: “আমার আব্বা আর দুই আম্মা। আমরা চার ভাই। ছেলেদের মধ্যে আমিই সবার বড়ো। আমার পর রয়েছে শাহরুখ, সেঠ আর সব্বার ছোটো বাবর। পাঁচ দিদির পর আমি জন্মেছিলাম।” তাঁদের ইসলামীয় ধারার নাম বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, “আমাদের গোণ্ড সমাজে হিন্দু-মুসলিম দুই কিসিমেরই নাম রাখা হয়। আমাদের কোনও মজহব নেই। আমরা জাতপাতেও বিশ্বাস করি না। হমারা ধরম কুছ অলগ হ্যায় [আমাদের ধর্মবিশ্বাস খানিক আলাদা]। আমরা রাজগোণ্ড।”
গণপরিসরে থাকা তথ্য অনুসারে আনুমানিক ৩০০ বছর আগে রাজগোণ্ড আদিবাসীদের একাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মুসলমান গোণ্ড বা মুসলিম গোণ্ড বলা হত। মহারাষ্ট্রের নাগপুর আর জলগাঁও জেলায় গেলে এই মুসলিম গোণ্ড জনগোষ্ঠীর জনাকয় সদস্যের সঙ্গে দেখা হবে। তবে আমজাদ মুরাদ এ ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নন।
“আমরা মুসলিমদের বিয়েশাদি করি না। কেবলমাত্র গোণ্ডদের করি। আমার বউয়ের নাম চন্দনী গোণ্ড,” তিনি বলে চললেন, “আমার তিন মেয়ের নাম লাজো, আলিয়া আর আলিমা। ওরা তো প্রত্যেকেই গোণ্ড, তাই না?” কারও নাম দিয়ে যে তার মজহব শনাক্ত করা যায়, এটা মানতে তিনি নারাজ। তাঁর পাঁচ দিদির কথাও জানালেন আমজাদ সাহেব, “বড়দি নিশোরী, তার পরের জন রেশমা। সৌসল আর দিদোলি বয়সে রেশমার চেয়ে ছোটো। নিজেই দেখুন, সবকটাই গোণ্ড নাম। অথচ ছোড়দির নাম মেরি। ইয়েহ নাম কিরিশচান মেঁ আতা হ্যায় [এই নামটা তো খ্রিস্টান]। তাতে কোনও গণ্ডগোল নেই। আমাদের যা ভাল্লাগে সেই নামটাই রাখি।” নিশোরীর বয়স ৪৫, আর মেরি পা রেখেছেন তিরিশের কোঠায়। প্রত্যেকেরই বিয়েথা হয়েছে গোণ্ড ছেলেদের সঙ্গে। এঁদের কেউই স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোননি।
আমজাদ সাহেবের স্ত্রী চন্দনীও নিরক্ষর। মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, “মেয়েরা একটা সরকারি স্কুলে ক্লাস করতে যায়। তবে আমাদের সমাজে মেয়েদের বেশিদূর লেখাপড়া করায় কেউ উৎসাহ দেয় না।”
“আমার এক ছেলের নাম নওয়াজ, আরেকটার নাম গরিব!” খ্বাজা মইনুদ্দিন চিশতিকে 'গরিব নওয়াজ' বলে সম্ভাষণ করা হয়, অর্থাৎ দীন-দুঃখীর ত্রাতা। এ উপাধির দুটি শব্দ দিয়ে নিজের দুই পুত্রের নামকরণ করেছেন আমজাদ সাহেব। “নওয়াজের তো একবছরও হয়নি। তবে গরিব যাতে ভালো করে পড়াশোনা করে, এটা আমি নিশ্চিত করবই। মরে গেলেও আমি ওকে আমার মতন ভবঘুরে হতে দেব না!” গরিব গোণ্ডের বয়স ৮, সে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, তবে এ ছেলে কিন্তু ইতিমধ্যেই সে তার কাওয়াল বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
আমজাদ মুরাদের পরিবারের পুরুষরা পেশা হিসেবে কাওয়ালিকেই বেছে নিয়েছেন।
“জানেন তো, আমরা গোণ্ডরা চাইলে যা ইচ্ছে তাই বেচতে পারি, এমনকি মাটির একটা ডেলাও। আমরা লোকের কান সাফ করি। খেজুর বেচি। ঘর সে নিকল গয়ে, তোহ হাজার-পাঁচ শৌ কামাকেচ লাতেঁ [কাজে বেরোলে ৫০০-১০০০ না কামিয়ে বাড়ি ফিরি না]!” তবে কিঞ্চিৎ নালিশও শোনা গেল তাঁর কথায়, “লোকে বড্ড আলতু-ফালতু খরচা করে। একটা ফুটোকড়িও জমায় না। আমাদের কোনও বাঁধাধরা পেশা নেই। কেউ কোনও ধরনের চাকরিবাকরিও করে না।”
হাজার ঢুঁড়েও পাকা চাকরি বা রুজিরুটির স্থায়ী কোনও পন্থা না খুঁজে পেয়ে কাওয়ালির দরবারে এসে হাজির হয়েছিলেন আমজাদ মুরাদ সাহেবের আব্বা। “ঠাকুর্দার মতো আব্বাও এ গাঁয়ে সে গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে জড়িবুটি আর খেজুর বিক্রি করত। বাবার বরাবরই গানবাজনার শখ ছিল, শেষে কাওয়ালির পথ খুঁজে পায়। আব্বা যেখানেই যেত, আমি লেজুড় হয়ে থাকতাম। ধীরে ধীরে ফাংশান-টাংশানে গাইতে শুরু করল মানুষটা। বাবাকে দেখে দেখে আমিও এ শিল্পে হাত পাকিয়ে ফেললাম।”
“আপনি কখনও স্কুলে যাননি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এক প্যাকেট চুন বার করে, আঙুলের ডগায় করে খানিকটা চুন খাবলে, সেটা জিভ দিয়ে চেটে আমজাদ সাহেব উত্তর দিলেন, “ক্লাস ২-৩ অবধি স্কুলে গিয়েছি। তারপর থেকে আর যাইনি। তবে লিখতে-পড়তে পারি। আমি ইংরেজিও জানি।” তাঁর মনে হয়, লেখাপড়া চালিয়ে গেলে জীবনে আরও উন্নতি করতে পারতেন। এ নিয়ে কম আফসোসও নেই তাঁর, “উস কে ওয়াজহ্ সে হম্ পীছে হ্যাঁয় [এইজন্যই তো আমি পিছিয়ে পড়েছি]।” কথাটা তাঁর ভাইদের ক্ষেত্রেও খাটে। তাঁদের প্রত্যেকেই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, আর বড়দার মতোই লিখতে-পড়তে শেখেন। ব্যাস, তারপর পেটের দায় এসে স্কুলজীবনে ঢ্যাঁড়া কেটে দিয়ে যায়।
“আমাদের গাঁয়ে মোট ৫০ ঘর গোণ্ডের বাস। বাকিরা হয় হিন্দু নয় মুসলমান বা 'জয় ভীম [দলিত নববৌদ্ধ]'। সব্বাই রয়েছে,” আমজাদ মুরাদ জানাচ্ছেন, “আমরা বাদে অন্য সব বেরাদরিতেই শিক্ষিত লোকজন পাবেন। তবে আমার ভাইপোটা লেখাপড়া করেছে। ওর নাম শিব।” শিব গোণ্ড ১৫-১৬ বছর বয়েস অব্দি পড়াশোনা করার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আপাতত সে পুলিশের চাকরি পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, আমজাদ সাহেব বললেন। বাড়ির উঠতি প্রজন্মের অন্তত একজন তো ক্যারিয়ার তথা শিক্ষা-দীক্ষার কথা চিন্তাভাবনা করছে, এটা কম নয়।
ক্যারিয়ার অবশ্য আমজাদ মুরাদ গোণ্ডেরও আছে। “আমাদের একটা দল আছে, কেজিএন কাওয়ালি পার্টি।” কেজিএন ভাঙলে দাঁড়াবে 'খ্বাজা গরিব নওয়াজ'। ভাইদের সঙ্গে মিলে এটা শুরু করেছিলেন আমজাদ মুরাদ সাহেব। বিয়েশাদি তথা নানান অনুষ্ঠানে গানবাজনা করেন তাঁরা। “আপনাদের রোজগারপাতি কত হয়?” প্রশ্ন করলাম। জবাব এল, “সেটা সংগঠকের উপর নির্ভর করছে। পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার পর্যন্ত হয়। দর্শকরাও কিছু কিছু টাকাকড়ি দেয়। সব মিলিয়ে একেকটা প্রোগ্রামে পনেরো-বিশ হাজারের মতো রোজগার হয়।” দলের প্রত্যেকের মধ্যে টাকাটা ভাগ হয়, মাথা-পিছু ২-৩ হাজারের বেশি থাকে না। শাদি-নিকাহর মরসুম কাটলে অনুষ্ঠানের পালাও সাঙ্গ হয়, তখন পুণে চলে আসেন আমজাদ সাহেব।
খেড় শিবপুরের এই হজরত কমর আলি দরবেশের দরগায় এলে অবশ্য কিছু না কিছু আয়-ইনকাম তাঁর হয়ই। রাত্তিরটা এই ভূগর্ভস্থ অংশেই কাটান। “উপরওয়ালা ভুখা নহিঁ সুলাতা [খোদা কখনও ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমোতে যেতে দেন না]!” মনস্কামনা পূর্ণ হলে অনেকেই দাওয়াত বা খাবারদাবারের ইন্তেজাম করেন। আমজাদ সাহেব এখানে সপ্তাহখানেক কাটান, কাওয়ালি পরিবেশন করেন, তারপর যেটুকু রোজগার হয় তা নিয়ে ঘরের পথে পা বাড়ান। এটাই তাঁর জিন্দেগির সিলসিলা। দরগায় কত রোজগার হয়, সেকথা জিজ্ঞেস করলে আমজাদ মুরাদ বলেন যে ওই ১০,০০০-২০,০০০ টাকার মতো। “তবে অতিরিক্ত লোভ ঠিক নয়। আয়-ইনকাম আরও বেশি হলেই বা, অত টাকা রাখবেন কোথায় শুনি? তাই যেটুকু পাই, তা নিয়েই দেশগাঁয়ে ফিরি,” জানালেন তিনি।
“ওটুকু দিয়ে জীবনধারণ মুমকিন?” সওয়াল করলাম। “হাঁ, চল্ যাতা হ্যায় [হ্যাঁ, চলে যায়]! গাঁয়ে ফিরে কাজকম্মও তো করি,” উত্তর দিলেন আমজাদ মুরাদ গোণ্ড। তবে কিনা দেশগাঁয়ে তাঁর না আছে কোনও জমিজমা, না রয়েছে অন্য কোনও সম্পত্তি, তাই 'কাজকম্ম' বলতে তিনি ঠিক কী বলতে চাইছেন সেটাই ভাবছিলাম মনে মনে।
আমজাদ সাহেব অবশ্য চটজলদি সে ধন্দ কাটিয়ে দিলেন। “রেডিয়ামের কাজ। আরটিও [আঞ্চলিক পরিবহণ দফতর] অফিসে গিয়ে গাড়িঘোড়ার নম্বর প্লেট আর নাম আঁকি,” বুঝিয়ে বললেন তিনি, “কাওয়ালির প্রোগ্রাম তো কালেভদ্রে জোটে, তাই কিছু একটা কাজ জোটাব বলে ঠিক করেছিলাম। বোঁচকাটা কাঁধে তুলে খানিক রেডিয়াম রং কিনে ফেললাম। পথে একখান গাড়ি দেখে থমকে দাঁড়ালাম, তারপর বিয়ের কনের মতো সেটাকে সাজিয়ে দিলাম।” এটাই তাঁর 'সাইড বিজনেস', এখানেও সেই শিল্পের ছোঁয়া। রংতুলি হাতে পথে পথে ফিরে খানিক উপরি রোজগার করেন তিনি।
রুজিরুটির পন্থাও সীমিত, হাতেগোনা ক'জন বাদে তাঁর শিল্পের তারিফও কেউ করে না। ফলে আমজাদ সাহেবের বেরাদরির কাছে ভবিষ্যতের মূলধন বলতে তেমন কিছু নেই বললেই চলে। তবে দিনকাল খানিকটা হলেও বদলেছে। ভারতীয় গণতন্ত্র এসে উমিদের আলো জ্বেলেছে তাঁদের জীবনে। “আমার আব্বা গাঁয়ের সরপঞ্চ [গ্রামপ্রধান],” তিনি জানাচ্ছেন, “গাঁয়ের জন্য অনেক কিছু ভালো ভালো জিনিস করেছে। আগে তো চারদিকে শুধু মাটি আর কাদা ছিল, আব্বাই তো পাকা সড়ক বানালো।”
স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণ প্রথার ফলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। তবে আমজাদ মুরাদ গোণ্ড কিন্তু স্বজাতির উপর বেশ খাপ্পা। “সরপঞ্চের মাথা ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া কি উচিত? অথচ আমার বেরাদরির লোকজন ঠিক সেইটাই করছে। হাতে খানিক কাঁচা টাকা এলেই ব্যাটারা মাছ-মাংস কিনে ভোজ লাগায়। ফুর্তি করে পুরো টাকাটা উড়িয়ে দেয়। আগামীর কথা কেউ ভাবে না,” বেশ বিরক্ত হয়েই নালিশ ঠুকলেন আমজাদ সাহেব।
“কাকে ভোট দেন আপনি?” নির্বাচন জিনিসটা একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় জেনেও এটা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। “আগে আগে পাঞ্জা ছাপে [ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির চিহ্ন] ভোট দিতাম। এখন চারদিকে বিজেপির হাওয়া বইছে। আমাদের কাস্ট পঞ্চায়েত যা মনস্থির করবে, আমরা তাকেই ভোট দেব। জো চল্ রাহা হ্যাঁয়, উওহিচ চল্ রাহা হ্যাঁয় [চারিধারে যা চলছে, সেটাই চলবে]। রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনও লেনদেন নেই,” এই বলে প্রশ্নটা ঝেড়ে ফেললেন তিনি।
“আপনি মদ খান?” সওয়ালটা করতে না করতেই তড়িৎগতিতে জবাব দিলেন আমজাদ সাহেব, “নাহ্! কক্ষনো না...না বিড়ি, না মদ। মেরা ভাই বিড়িয়া পীতে, পুড়িয়া খাতে [আমার ভাইগুলো সব বিড়ি খায় আর গুটখা চিবোয়]। কিন্তু আমি ছুঁই না। আমার ওসব বদ অভ্যেস নেই।” এই অভ্যেসগুলো ঠিক কী কারণে 'বদ', তা জানতে চাইলাম ওঁর কাছে।
“আমার পথচলার রাস্তাটা এক্কেবারে আলাদা! কেউ যদি নেশাভাঙ করে কাওয়ালি গায়, তার ইজ্জত খোওয়া যেতে বাধ্য। কেউ কেনই বা এরকম আচরণ করবে শুনি? ঠিক এই কারণেই আমি আজীবন এসব অভ্যেস এড়িয়ে চলেছি,” সাফ কথা আমজাদ মুরাদ গোণ্ডের।
কোন কাওয়ালি আপনার পছন্দ? “ওই যেটা সংস্কৃতে লেখা। ওটা গাইতেও ভাল্লাগে, শুনতেও,” বললেন তিনি। সংস্কৃত কাওয়ালি? তাজ্জব বনে গেলাম। “আসলম সাবরি গেয়েছেন, 'কিরপা করো মহারাজ...' আহা, কী মিঠে তার সুর। আমার জন্য যেটা রূহ ছুঁয়ে যায়, সেটাই সংস্কৃত। কাওয়ালি ভগবান কে লিয়ে গাও, ইয়া নবী কে লিয়ে, দিল্ কো ছুঁ যায়ে বস্ [কাওয়ালি ঈশ্বরের জন্য গাও বা নবীর জন্য, যদি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তাতেই যথেষ্ট]!” বুঝিয়ে বললেন বিষয়টা।
আমজাদ মুরাদের কাছে যে কাওয়ালি হিন্দু দেবদেবীর বন্দনা করে, সেটাই 'সংস্কৃত'। আখর আর বুলি নিয়ে চুলোচুলি করে শুধু আমরাই মরছি।
দুপুর হতে চলল, এদিকে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে সওয়ালির ঢল। মাজারের সামনে একদল পুরুষ দেখলাম জড়ো হয়েছে। কয়েকজনের মাথায় ফেজটুপি, বাকিদের মাথায় রুমাল বাঁধা। গর্জন উঠল, “ইয়া...কমর আলি দরবেশ...” সবাই মিলে শুধু আঙুলের জোরেই সেই ওজনদার পাথরটা তুলে সজোরে আছড়ে ফেলল শানে।
এদিকে আমজাদ মুরাদ গোণ্ডের গানে গানে একাকার হয়ে যাচ্ছে দেবদেবী ও নবী।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র