মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলায়, জাঁতাকলে ঘাম ঝরানো মহিলাদের ভক্তিভরা গানে উঠে এল বহুলবন্দিত এক মেষপালকের কথা

সেই যেখানে জাঁতাপেষাইয়ের গানের (জিএসপি) আদি দলটির জন্য আজ দু’দশক আগে গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন মহিলারা, তাঁদেরই খোঁজে ১৯টি নামের তালিকা নিয়ে কোলাপুরের মেটাগে গ্রামে পৌঁছাল পারি। গাঁয়ের মেয়ে-বুড়ো সব্বার নজর কেড়েছিল ইয়াব্বড় ক্যামেরা নিয়ে আসা এতগুলো লোক।

এক বাড়ির দোরগোড়ায় জনৈক মহিলা বসেছিলেন, তাঁকেই গিয়ে শুধালাম — এককালে পুণে থেকে আসা লোকজনের জন্য গান গেয়েছেন, এমন কাউকে চেনেন নাকি? “হ্যাঁ,” জবাব এল, “আমরাই তো জাট্যাভারচি ওভ্যা [জাঁতাপেষাইয়ের গান] গেয়েছিলাম। গাইয়ের দলে আমিও ছিলাম।”

তালিকায় থাকা একজনের সঙ্গে মোলাকাত হওয়ায় যারপরনাই খুশি হলাম! সোনা ভরমল। বছর ষাটেকের সোনা আই জানালেন, উনি ছাড়া সেই গায়কদের আর মোটে একজনই মেটাগে গাঁয়ে এখনও বসবাস করেন — লক্ষ্মী দাওয়ারি।

Left: Singer Sona Pandurang Bharmal, in her 60s.
PHOTO • Samyukta Shastri
Right: Singer Laxmi Shamrao Dawari
PHOTO • Samyukta Shastri

বাঁদিকে: ষাটের কোঠায় পা রেখেছেন গায়ক সোনা পান্ডুরঙ্গ ভরমল। ডানদিকে: গায়ক লক্ষ্মী শামরাত দাওয়ারি

Left: Singer Sunita Shankar Jadhav.
PHOTO • Samyukta Shastri
Right: Singer Bayana Kamble, who had passed away in the years since they had sung for the original GSP team two decades ago.
PHOTO • Samyukta Shastri

গায়ক: গায়ক সুনীতা শংকর যাদব। ডানদিকে: প্রয়াত গায়ক বায়ানা কাম্বলে, দুই দশক আগে জাঁতাপেষাইয়ের গানের আদি দলটিকে তিনিও গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন

২০১৮ সালে জিএসপির আদি দলটির জন্য গান গাওয়ার পর বায়ানা কাম্বলের মতো একে একে অনেকেই মারা গিয়েছেন। তাঁর পুত্র অশোক কাম্বলে আমাদের বলেছিলেন: “আমার আই আর তাঁর বন্ধু সাখুবাই কাম্বলে দুজনেই বেশ নামজাদা গাইয়ে ছিলেন। একসঙ্গে আখখেতে কাজ করতে করতে গাইতেন।”

লোকে কাগাল তালুকের এই গ্রামটিকে বালুমামাচে [বালুমামার] মেটাগে বলেই চেনে। বহু দশক আগে এখানেই বাস করতেন জনশ্রুতিতে প্রবাদপ্রতিম হয়ে ওঠা বালুমামা। সেই মেষপালকের নামে একটি মন্দিরও রয়েছে এই গাঁয়ে। প্রস্তরনির্মিত সেই দেউলের দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ভেড়ার মূর্তি। বালুমামার বিরাসত ও এই দেবালয়ের জনপ্রিয়তা, আজও সমান বিদ্যমান। নতুন প্রজন্মের মননেও দেখলাম দিব্যি জায়গা করে নিয়েছেন বালুমামা।

বালুমামা কখন তাঁদের জমিনে ভেড়া চরাতে আসবেন, বীজ রোয়ার আগে তারই অপেক্ষায় প্রহর গুনতেন মেটাগের চাষিরা — গ্রামের মহিলাদের মুখে শুনলাম। হ্যাঁ, ভেড়ার লাদি উৎকৃষ্ট জৈবসার বটে, ফলন বেশ জম্পেশ হয়, তবে কৃষকের দল মনপ্রাণে মানতেন যে বালুমামার ভেড়ার পাল কারও খেতে চরতে এলে ওই মরসুমে ফুলে-ফলে ভরে উঠবে সে জমি।

আদতে বালাপ্পা নামের এই রাখালের জন্ম ১৮৯২ সালের অক্টোবরে কর্ণাটক রাজ্যে। বেঁচে থাকতে থাকতেই সন্তের মর্যাদা লাভ করেন, তারপর ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ সালে দেহ রাখেন মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার আদামাপুর গ্রামে। মারাঠি বই, টিভি সিরিয়াল আর জনপ্রিয় মারাঠি ও কন্নড় ছায়াছবিতে অমর হয়ে আছেন বালুমামা।

Left: A billboard for the temple dedicated to the revered shepherd-saint Balumama and his wife Satyavadevi in Metage village, Kolhapur .
PHOTO • Samyukta Shastri
Right: The entrance to the temple is flanked by stone sculptures of rams
PHOTO • Samyukta Shastri

বাঁদিকে: কোলাপুরের মেটাগে গ্রামে, শ্রদ্ধেয় সন্ত বালুমামা ও তাঁর স্ত্রী সত্যভাদেবীর প্রতি নিবেদিত মন্দিরের সাইনবোর্ড। ডানদিকে: দেউলের ফটকের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মেষমূর্তি

*****

২০১৮ সালে পারি বালুমামাচে মেটাগেতে হাজির হলে জনা দশেক মহিলা আমাদের গান শোনাতে জড়ো হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে জনাকয় এমনও ছিলেন যাঁরা সেই বছর কুড়ি আগে জিএসপির আদি দলটির ভ্রমণকালেও সংগীত পরিবেশন করেছিলেন।

হরেক কিসিমের লোকগীতি তো শুনলামই, পিড়াপিড়ি করায় খুশি মনে জাঁতাপেষাইয়ের গানও গাইলেন তাঁরা। খুঁজে পেতে একখান পাথরের জাঁতাকল এনে, ঊর্ধ্বাংশের ফুটোয় কাঠের হাতল লাগিয়ে কুমকুম (সিঁদুর) ও হলদি (হলুদ) সহকারে পুজো দিলেন সেই মহিলারা।

তারপর প্রদীপ জ্বেলে জোড়হাতে শুরু হল বন্দনা ও গানের পালা।

দেখতে দেখতে দ্রুত হল সংগীতের লয়, গায়কবৃন্দের কণ্ঠস্বর পরস্পরের সঙ্গে মিলে বইতে লাগল একস্রোতে। আটটি ওভির যে সংকলনটি পারি রেকর্ড করেছে, সেখানে প্রধান গায়ক সুলাবাই যাধব, বাকিরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গত রেখে ধুয়ো তুলছিলেন।

Sulabai Ravishankar Jadhav, the lead singer of the group, explains the rhythms of the songs and ensures synchrony as the other singers join her
PHOTO • Samyukta Shastri
Sulabai Ravishankar Jadhav, the lead singer of the group, explains the rhythms of the songs and ensures synchrony as the other singers join her
PHOTO • Samyukta Shastri

গানের ছন্দ বোঝালেন দলের প্রধান গায়ক সুলাবাই রবিশঙ্কর যাধব। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাকিরা যোগ দিলে গানের সামঞ্জস্য বজায় রাখার দায়িত্বটাও তাঁর উপর বর্তায়

Left: Singer Gitanjali Diwan Dawari.
PHOTO • Samyukta Shastri
Right: Singer Hemal Ramchander Bharmal
PHOTO • Samyukta Shastri

বাঁদিকে: গায়ক গীতাঞ্জলি দিওয়ান দাওয়ারি। ডানদিকে: গায়ক হেমল রামচন্দর ভরমল

“পয়লা সে গান সই জ্যোতিবা দেবের তরে,” দিয়ে শুরু হল ওভির পালা। এই প্রথম দোহাটি কোলাপুরের লোকদেবতা জ্যোতিবার প্রতি নিবেদিত। গানে গানে তাঁর পায়ে পৈতে স্বরূপ দু’ছড়া মুক্তোর মালা চড়ালেন গায়ক।

পরের তিনটি ওভির নায়ক কিংবদন্তীর বালুমামা, যিনি “দেবতুল্য।”

মাঝরাতে চাঁদ যখন মেঘের আড়ালে লুকোয়, অর্থাৎ ব্যাপক ফলনের আশীর্বাদস্বরূপ চাষিদের “রাশি রাশি মুক্তো” দান করেন বালুমামা।

গান এগোতে থাকে। গাইয়ে জানান যে তিনি অম্বিল (জাউ) বানাবেন বলে জাঁতায় জোয়ার ও ধান কুটছেন। বালুমামার চেহারাখানা বেশ লম্বা-চওড়া — পালোয়ান (কুস্তিগীর) বলে কথা! ফর্সা দেহ, দুধ খেতে বড্ড ভালোবাসেন। চড়া রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পশু চরালে যে কারও চামড়া তেতে-পুড়ে যাবে, অথচ বালুমামা গৌরবর্ণ, হয়তো বা দুধের দৌলতেই — অন্তত গানের ইঙ্গিতটা তো সেদিকেই।

Left: Singer Darkubai Ravan Mane.
PHOTO • Samyukta Shastri
Right: Singer Muktabai Anant Tambekar.
PHOTO • Samyukta Shastri

বাঁদিকে: গায়ক দারকুবাই রাবণ মানে। ডানদিকে: গায়ক মুক্তাবাই অনন্ত তাম্বেকর

Left: Anubai Govinda Mane.
PHOTO • Samyukta Shastri
Right: Suman Shivaji Satvekar
PHOTO • Samyukta Shastri

বাঁদিকে: অনুবাই গোবিন্দ মানে। ডানদিকে: সুমন শিবাজী সাত্বেকর

ওভিগুচ্ছের শেষের চারটি গানে প্রকাশিত হয়েছে গায়কের ভক্তিরস। গৃহকোণ আলোয় আলোকিত করে তুলতে তিনি আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন দেবী অম্বিকাকে। পানঢারী বা পনঢারপুর নগরের প্রশংসায় গায়ক পঞ্চমুখ, কারণ সেটি বিট্ঠল ও রুক্মিণীর বাসস্থান। “রুক্মিণী থাকে সেথা, মহারাণী সাজ — চৌদ্দ চৌকটির অন্তত রাজ,” ঘুরন্ত জাঁতার তালে তালে গাইছেন সেই মহিলা।

তুলসীর বাগানে বাগানে ছয়লাপ পনঢারপুর, এমনকি “বিট্ঠল ঠাকুরের ওই জয়রথ, চলিতে না পারে সই নাহি কোনও পথ।”

সর্বশেষ ওভিতে ফুটে উঠছে ভক্তবৃন্দের প্রতি বিট্ঠলের অনন্ত স্নেহ। দোহায় ভক্তিধারার খ্যাতনামা সন্ত-কবি, বিট্ঠলের পরম উপাসক নামদেবের অনুষঙ্গ এনেছেন গায়ক। এই অঞ্চলে কারও পুত্রসন্তান হলে তার জন্মের ১২ দিন পর নাম দেওয়া হয়। গায়ক বলছেন, নামদেবের ছেলে হওয়ায় খোদ বিট্ঠল ঠাকুর বাচ্চাটির নামকরণের আয়োজন করেছিলেন।

মহারাষ্ট্রের বালুমামাচে মেটাগে গাঁয়ের ১০জন মহিলার কণ্ঠে এই ওভিগুলি শুনুন।

ভিডিওটি দেখুন: এক রাখাল-সাধকের প্রতি নিবেদিন গান

ওভিগুলি শুনুন

পয়লা সে গান সই জ্যোতিবা দেবের তরে,
পৈতে সাজাই তাঁর দু’ছড়া মুকুতা ভরে

মাঝরাতে ওই চন্দ্র লুকোয় ঘনঘোর মেঘছায়ে,
বালুমামা সই দেবতার মতো মুকুতা দিলো লুটায়ে

জনারের সাথে গুঁড়াইছি চাল, বানাইতে হবে জাউ,
দুপুরের রোদ, বালুমামা মোর পরমের সুখে তাও

নধরকান্তি ঘুমাইছে কে দেখি, শান্ত সে বালুমামা,
মল্লযোদ্ধা, ভালোবাসে দুধ, দুধ চাহে বালুমামা

ওই মেয়ে, শোন্ শোন্! পাঠাস আমন্ত্রণ দেবীমার কাছে,
ঈশ্বরী মোর, তার অম্বিকা নাম, সে যে ঠাকুরানি আছে

এবড়োখেবড়ো জমি পনঢারি ওই — হয়েছিল গড়া জানি শোন্ দেখি সই
রুক্মিণী থাকে সেথা, মহারাণী সাজ — চৌদ্দ চৌকটির* অন্তত রাজ

পনঢরপুরে কটা তুলসি বাগান, না জানি লাগানো হ’ল, মন আনচান,
বিট্ঠল ঠাকুরের ওই জয়রথ, চলিতে না পারে সই নাহি কোনও পথ

শোন্ মেয়ে শোন্ শোন্, গাহি আজি সুরে, অলিগলি সেজে ওঠে পনঢরপুরে,
নামদেবসূত, তার নাম দেওয়া হবে, বিট্ঠল খোদ এসে সেই নাম দিবে

*চৌদ্দ চৌকটি শন্দবন্ধের দ্বারা পন্ধরপুরে বিট্ঠল ও রুক্মিণীর রাজত্বকালের কথা বোঝানো হয়েছে। ধর্মীয় লোকবিশ্বাস বলে, এ রাজত্ব শতসহস্র যুগ ধরে অক্ষয় রবে। হিন্দুশাস্ত্র মোতাবেক কৃত/সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগ মিলিয়ে এক চৌকটি বা চৌকড়ি। ভক্তিধারার সন্ত-কবি তুকারামের একটি পদ ছাড়াও সাহিত্যে এই শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

পরিবেশক/গায়ক: সুনীতা যাদব, সোনা ভরমল, লক্ষ্মী দাওয়ারি, সুলাবাই যাদব, গীতাঞ্জলি দাওয়ারি, হেমল ভরমল, দারকুবাই মানে, মুক্তাবাই তাম্বেকর, অনুবাই মানে, সুমন সাত্বেকর

গ্রাম: বালুমামাচে মেটাগে

তালুক: কাগাল

জেলা: কোলাপুর

তারিখ: গানের রেকর্ডিং ও ছবি তোলা হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৭ই মে।

পোস্টার: সিঞ্চিতা মাজি

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জাঁতাপেষাইয়ের গানের আদি দলটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Namita Waikar is a writer, translator and Managing Editor at the People's Archive of Rural India. She is the author of the novel 'The Long March', published in 2018.

Other stories by Namita Waikar
PARI GSP Team

PARI Grindmill Songs Project Team: Asha Ogale (translation); Bernard Bel (digitisation, database design, development and maintenance); Jitendra Maid (transcription, translation assistance); Namita Waikar (project lead and curation); Rajani Khaladkar (data entry).

Other stories by PARI GSP Team
Video Editor : Sinchita Parbat

Sinchita Parbat is a Senior Video Editor at the People’s Archive of Rural India, and a freelance photographer and documentary filmmaker. Her earlier stories were under the byline Sinchita Maji.

Other stories by Sinchita Parbat
Editor : PARI Team
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra