কয়েক মাস অসহ্য গরমের পর অবশেষে শীতের দেখা পেল মহারাষ্ট্রের মারাঠওয়াড়া। রাতের শিফ্টে বেরোনোর আগে মনের সুখে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছিলেন দামিনী (নাম পরিবর্তিত)। “আমার তখন পিএসও'র ডিউটি চলছিল, অস্ত্রশস্ত্র আর ওয়াকি-টকি বিলি করার দায়িত্বে ছিলাম,” তিনি জানাচ্ছেন।

কর্মস্থলে যেতেই স্টেশন পুলিশ অফিসার ওরফে পুলিশ ইন্সপেক্টর (এসএইচও/পিআই) ওয়াকি-টকির জন্য চার্জ দেওয়া ব্যাটারি নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আবাসনে আসতে বলেন দামিনীকে। আবাসনটা থানার চৌহদ্দির মধ্যেই। ততক্ষণে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, যদিও এসব কাজের জন্য দামিনীকে তাঁর নিজের বাড়িতে ডাকাটা প্রটোকলের বিরুদ্ধে, তবে এখানকার রীতিনীতি এরকমই। “অফিসাররা হামেশাই জিনিসপত্র সব নিজেদের ঘরে নিয়ে যান...আর ওপরওয়ালাদের হুকুম আমরা মানতে বাধ্য,” দামিনী বুঝিয়ে বললেন।

অতএব ভোররাত ১.৩০টা নাগাদ পায়ে হেঁটে ইন্সপেক্টরের আবাসনে পৌঁছান দামিনী।

গিয়ে দেখেন ঘরের ভিতর তিনজন পুরুষ বসে আছে: খোদ ইন্সপেক্টর, এক সমাজকর্মী এবং একজন থানা-করমচারী (খুচরো আধাসরকারি কামকাজ সামলাতে পুলিশ থেকে যেসব সিভিক ভলেন্টিয়ারদের নিয়োগ করা হয়)। “ওয়াকি-টকির ব্যাটারি পাল্টাতে হত, তাই ওদের পাত্তা না দিয়ে কামরার মধ্যে রাখা টেবিলটার দিকে গেলাম,” নভেম্বর ২০১৭ তারিখের সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে ইতস্তত বোধ করছিলেন তিনি। পিছন ঘুরতেই হঠাৎই দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে এল দামিনীর। “কামরা থেকে বেরোতে চেয়েছিলাম। প্রাণপণে চেষ্টাও চালাই, কিন্তু ওদের দুজন মিলে আমার হাতদুটো কষে ধরে খাটের উপর ছুঁড়ে দিলো আমায়, তারপর...এক এক করে আমায় ধর্ষণ করল।”

২.৩০টা নাগাদ কাঁদতে কাঁদতে আবাসন থেকে বেরিয়ে আসেন দামিনী। কোনওমতে নিজের বাইকে চেপে ঘরের দিকে রওনা দেন। “মাথাটা ভোঁভোঁ করছিল। খালি একটাই কথা ভাবছিলাম...আমার ক্যারিয়ার, আমি কী হতে চেয়েছিলাম। শেষে কিনা এই পরিণতি হল আমার?” বললেন তিনি।

PHOTO • Jyoti Shinoli

বহুযুগ ধরে তীব্র জলসংকটের সাক্ষী থেকেছে মহারাষ্ট্রের মারাঠওয়াড়া অঞ্চল, চাষবাস থেকে পাকাপোক্ত রোজগারের পন্থা এখানে লাগাতার কমছে। সুতরাং পুলিশের সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য সবাই হন্যে হয়ে পড়ে থাকে

*****

দামিনীর যদ্দূর মনে পড়ে, তিনি বরাবরই বরিষ্ঠ সরকারি আধিকারিক হতে চেয়েছেন। তাঁর আকাঙ্খা ও কঠোর মেহনতের সাক্ষী তাঁর তিনটে ডিগ্রি — ইংরেজি, শিক্ষা ও আইনে স্নাতক। “ছাত্রাবস্থায় আমি বরাবরই প্রথম সারিতে ছিলাম...ভেবেছিলাম, কনস্টেবলের পদে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে (আইপিএস) যোগ দিয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর নিয়োগ পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা আরম্ভ করব।”

২০০৭ সালে পুলিশের চাকরিতে ঢোকেন দামিনী। গোড়ার কয়েকটা বছর ট্রাফিক বিভাগে কাজ করতেন, মারাঠওয়াড়ার বিভিন্ন থানায় কনস্টেবল পদেও বহাল থেকেছেন। “বরিষ্ঠতা হাসিল করতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতাম, প্রতিটা মামলায় নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি,” স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি। অথচ, দিনান্ত এমন মেহনত সত্ত্বেও থানায় থানায় চলতে থাকা পুরুষ-আধিপত্যের অভিজ্ঞতা তাঁর মনোবল অনেকখানি ভেঙে দিয়েছে।

“পুরুষ সহকর্মীরা মাঝেমধ্যেই টিটকারি দিত, সরাসরি মুখের উপর নয় যদিও। বিশেষ করে জাতপাত আর অবশ্যই লিঙ্গের ভিত্তিতে,” দামিনী, তিনি নিজেও দলিত সমাজের মানুষ। “একবার এক কর্মী আমায় বলেছিল, 'তুমহি যার সাহেবাঞ্চা মর্জিপ্রমাণে রহিলিয়ৎ তার তূমহালা ডিউটি ভাগারে কমি লাগেই। পয়সে পন্ দেউ তুমহালা (স্যারের কথামতন চললে কাজও কম করতে হবে, পয়সাকড়িও মিলবে)'।” এই কর্মীটি আদতে সেই সিভিক ভলেন্টিয়ার, ধর্ষক হিসেবে অভিযুক্তদের একজন। দামিনী জানাচ্ছেন, থানায় আধাসরকারি কামকাজের পাশাপাশি সে পুলিশের হয়ে 'ওয়াসুলি', অর্থাৎ তোলাবাজি চালাত আর পিআইয়ের জন্য তাঁর আবাসনে, কিংবা হোটেল-লজে যৌনকর্মী তথা মহিলা কনস্টেবলদের “জোগান দিত”।

“নালিশ ঠুকতে গেলেও তো সেই ঊর্ধ্বতনদের সকলেই পুরুষ। আমাদের কথায় পাত্তাই দেয় না,” সংযোজন দামিনীর। যৌন হেনস্থা লিঙ্গ-বিদ্বেষ থেকে মহিলা সিনিয়র আধিকারিকদেরও রক্ষা নেই। ড. মীরন চাঢা বোরওয়াঙ্কর একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার, মহারাষ্ট্রের সর্বপ্রথম মহিলা নগরপাল হওয়ায় তাঁর বেশ নামডাক আছে। তিনি বলছেন যে মহিলা পুলিশকর্মীদের জন্য এদেশের কর্মস্থল বরাবরই অসুরক্ষিত। “কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা বাস্তব সত্য। কনস্টেবল স্তরের মেয়েদেরই সবচাইতে বেশি হেনস্থা হয় বটে, তবে উচ্চপদের মহিলা আধিকারিকরাও রেহাই পান না। আমি নিজেও এ জিনিস সহ্য করেছি,” তিনি জানালেন।

কাজের জায়গায় যৌন হয়রানি থেকে মহিলাদের রক্ষা করতে ২০১৩ সালে পাশ হয় কর্মস্থলে নারীদের যৌন হেনস্থা (প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার) আইন । নিয়োগকর্তাদের জন্য এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করাটা বাধ্যতামূলক। “থানাগুলো এই আইনের আওতায় পড়ছে এবং এর বিধানগুলো মেনে চলাটা আবশ্যিক। এক্ষেত্রে 'নিয়োগকর্তা' হচ্ছেন এসএইচও বা পিআই, আইনানুগ হওয়ার সকল দায়-দায়িত্ব তাঁরই উপর বর্তায়,” জোরগলায় বললেন পূর্ণা রবিশঙ্কর, তিনি বেঙ্গালুরুর অল্টারনেটিভ ল ফোরামে কর্মরত একজন উকিল। পূর্বোক্ত আইন অনুযায়ী কাজের জায়গায় হেনস্থার বিরুদ্ধে কেউ নালিশ ঠুকলে করলে তা সামলানোর জন্য অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আইসিসি) স্থাপন করাটা বাধ্যতামূলক, বিশেষত পিআইয়ের বিরুদ্ধে, যেমনটা দামিনীর ক্ষেত্রে হয়েছিল। তবে আইনি আদর্শের সামনে রূঢ় বাস্তবের আয়না তুলে ধরলেন ড. বোরওয়াঙ্কর: “অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইসিসি কেবল কাগজকলমেই রয়ে যায়।”

২০১৯ সালে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ (সিএসডিএস) 'ভারতবর্ষে পুলিশি ব্যবস্থার হাল-হকিকত' শিরোনামে একটি সমীক্ষা চালায় — তারা মহারাষ্ট্র সমেত ২১ রাজ্যের ১০৫টি জায়গায় ১১,৮৩৪ জন পুলিশকর্মীর সাক্ষাৎকার নেয়। তাঁদের কর্মস্থল তথা অধিক্ষেত্রে অনুরূপ কোনও কমিটি না থাকার কথা উঠে আসে প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪ শতাংশ) মহিলা পুলিশকর্মীর জবানে। ফলে, মহিলা পুলিশকর্মীরা যে কী পরিমাণে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন তার  পরিসংখ্যানগত ব্যাপ্তি নির্ণয় করা যায় না।

“আমাদের কোনদিনও এ আইনের বিষয়ে জানানো হয়নি। এরকম কোনও কমিটিও ছিল না,” খোলসা করে বললেন দামিনী।

২০১৪ থেকে কর্মক্ষেত্র বা অফিসের চৌহদ্দির ভিতর 'শ্লীলতাহানির অভিপ্রায়ে নারীর উপর আক্রমণ' ( অধুনা-সংশোধিত ভারতীয় দণ্ড বিধির ধারা ৩৫৪ , সদ্য পাশ হওয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বা বিএনএসের ৭৪ নং ধারার সমতুল) — এই বর্গের আওতায় ঘটতে থাকা যৌন হয়রানি ঘিরে তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে জাতীয় অপরাধ রেকর্ড অধিদপ্তর (এনসিআরবি)। ২০২২ সালে উক্ত বর্গের অধীনে ভারত জুড়ে অন্তত ৪২২টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে জাতীয় অপরাধ রেকর্ড অধিদপ্তর, যার মধ্যে ৪৬টি ঘটেছিল মহারাষ্ট্রে — মনে করা হচ্ছে এই সংখ্যা আদতে অবমূল্যায়ন।

*****

২০১৭ সালের নভেম্বরে সেই ভয়াবহ রাত্তিরে একরাশ প্রশ্ন মাথায় নিয়ে দামিনী ঘরে ফেরেন। মুখ খুললে তার পরিণতি কী হবে, কাজে গিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষকদের মুখদর্শন কীভাবে করবেন — এসব চিন্তা কুরেকুরে খাচ্ছিল দামিনীকে। “একটাই কথা ভাবছিলাম, সিনিয়রদের কুৎসিত প্রস্তাবে সাড়া দিইনি বলেই কি এটা [গণধর্ষণ] হল? এরপর কী করব?” মনে করে বললেন দামিনী। চার-পাঁচদিন পর কষ্টেসৃষ্টে সাহস জুগিয়ে কাজে ফেরেন বটে, তবে ঠিক করেন যে ঘটনাটি নিয়ে কিছু করবেন না বা বলবেন না। “ভিতরটা উথাল-পাথাল হচ্ছিল। কী কী পদক্ষেপ [যেমন ডাক্তারি পরীক্ষা, যেটায় দেরি করা চলে না] নেওয়া উচিত, সবই জানতাম, অথচ...কিছুই বুঝতে পারছিলাম না,” দ্বিধায় আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

তবে এর এক সপ্তাহ পর, লিখিত অভিযোগ নিয়ে মারাঠওয়াড়ার একটি জেলার পুলিশ-অধীক্ষকের (এসপি) কাছে যান দামিনী। এসপি সাহেব কোথায় এজহারনামা (এফআইআর) দাখিল করতে বলবেন, তা নয় দামিনীকেই কাঠগোড়ায় তোলেন — ঠিক যেটার ভয় পেয়েছিলেন তিনি। দামিনীর জবানে: “এসপি আমার থানা থেকে আমারই সার্ভিস রেকর্ড চেয়ে পাঠান। অভিযুক্ত ইন্সপেক্টর সেখানে উল্লেখ করে যে আমি নাকি দুশ্চরিত্র এবং কর্মস্থলে অশালীন আচরণে লিপ্ত হয়েছি।”

দিনকতক পর আবারও চিঠি লিখে এসপি সাহেবকে নালিশ জানান দামিনী, কিন্তু কোনও জবাব আসে না। “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করিনি, এমন একটাও দিন ছিল না। পাশাপাশি বরাদ্দ দায়-দায়িত্ব সামলেছি,” স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি, “শেষে জানতে পারি যে ধর্ষণের ফলে আমার পেটে বাচ্চা এসেছে।”

পরের মাসে ডাক ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পুলিশ-অধীক্ষককে আরেকটি চারপাতার অভিযোগপত্র পাঠান দামিনী। অবশেষে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে, অর্থাৎ অভিযোগে বর্ণিত গণধর্ষণের পাক্কা দু'মাস পর প্রাথমিক তদন্তের হুকুম আসে। “তদন্তের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন জনৈক মহিলা সহকারী পুলিশ-অধীক্ষক (এএসপি)। আমার গর্ভাবস্থার যাবতীয় রিপোর্ট ওঁর কাছে জমা দিয়েছিলাম, অথচ তদন্তের ফলাফল পেশ করার সময় উনি সেগুলো বাদ দিয়ে দেন। এএসপি ম্যাডাম সিদ্ধান্ত নেন যে যৌন নির্যাতন নাকি হয়ইনি, আরও তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত জুন ২০১৯-এ আমায় বরখাস্ত করা হয়,” জানালেন দামিনী।

PHOTO • Priyanka Borar

'নালিশ ঠুকতে গেলেই বা কি, ঊর্ধ্বতনদের সকলেই তো পুরুষ। আমাদের কথায় পাত্তাই দেয় না,' দামিনী জানাচ্ছেন। যৌন হেনস্থা আর লিঙ্গ-বিদ্বেষ থেকে মহিলা সিনিয়র আধিকারিকদেরও রক্ষা নেই

এতকিছুর মাঝে বাড়ির লোকের থেকে একফোঁটা সমর্থন পাননি তিনি। ধর্ষণের একবছর আগেই, ২০১৬ সালে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল। চার বোন ও এক ভাইয়ের মাঝে দামিনীই সবার বড়ো। বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল, মা গৃহিণী — ভেবেছিলেন যে অন্তত এঁরা দুজন তাঁর পাশে থাকবেন। “কিন্তু অভিযুক্তদের একজন আমার নামে আমার বাবার কানে কুকথা তোলে... বলে যে আমি নাকি থানায় যৌনকর্মে জড়িত আছি...আমি নাকি ফালতু মেয়ে...ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে বেকার বেকার ঝামেলায় জড়ানো উচিত নয়,” দামিনী বললেন। বাবা তাঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলে দামিনীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। “বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কিন্তু মনস্থির করলাম যে পাত্তা দেব না। আর কীই বা করতাম বলুন?”

উপরন্তু দামিনী টের পান যে তাঁকে সর্বদা নজরবন্দি করে রাখা হচ্ছে। “আমি যেখানেই যেতাম আমার পিছু পিছু তিনজন অভিযুক্ত, বিশেষ করে ওই করমচারীটি যেত। সারাটাক্ষণ তক্কে তক্কে থাকতাম। দুচোখের ঘুম উড়ে গেছিল, ঠিক করে খেতেও পারছিলাম না। শরীর-মন দুটোই যেন কেউ নিংড়ে নিয়েছিল।”

তবে হাল ছাড়ার পাত্র তিনি ছিলেন না। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর জেলার কোনও একটি তালুকের প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (জেএমএসসি) আদালতের দ্বারস্থ হন দামিনী। কিন্তু একজন সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাঁর ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি (অধুনা-সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধি ১৯৭ নং ধারা, সদ্য পাশ হওয়া ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা বা বিএনএসএসের ২১৮ ধারার সমতুল) নেননি বলে মামলাটা খারিজ করে দেওয়া হয়। তার এক সপ্তাহ পর, তিনি আবারও মামলা রুজু করায় শেষমেশ অতিরিক্ত জেলা দায়রা আদালত থেকে এজহারনামা জমা নেওয়ার আদেশ যায় পুলিশ থানায়।

“তিনটে মাস মুষড়ে পড়ে থেকে উদ্বেগে অবসাদে কাটানোর পর আদালতের হুকুমে মনটা খানিক চাঙ্গা হয়েছিল,” ফেলে আসা সেই মুহূর্তটা আবারও জিইয়ে নিলেন দামিনী। এফআইআর দায়ের হওয়ার দু'দিন পর অভিযোগ মোতাবেক অপরাধস্থল, অর্থাৎ সেই ইন্সপেক্টরের আবাসনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। দামিনী সেই সেদিন রাতে পিআইয়ের ঘরে যাওয়ার পর থেকে তিনমাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে, সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই কোনও তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি।

সেই মাসেই গর্ভপাত হয়ে পেটের বাচ্চাটিকে খুইয়ে বসেন দামিনী।

*****

দামিনীর মামলায় সর্বশেষ শুনানি হয়েছিল ২০১৯ সালের জুলাইয়ে, তারপর কেটে গেছে পাঁচ বছরেরও বেশি। বরখাস্ত থাকাকালীন তিনি বারংবার চেষ্টা করেছিলেন ঘটনাটি মহাপরিদর্শকের (ইন্সপেক্টর জেনারেলের বা আইজি) কানে তোলার, কিন্তু সাক্ষাৎ দেখা করার সুযোগটুকুও মেলেনি। শেষে একদিন মরিয়া হয়ে আইজির গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন দামিনী, মোটরগাড়ি থামতেই নিজের দাস্তান তুলে ধরেন মহাপরিদর্শকের সামনে। “ওঁর কাছে আবেদন করি, আমার বিরুদ্ধে যা কিছু অন্যায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সব জানাই ওঁকে। তখন উনি হুকুম দেন, আমায় যেন আবার করে কাজে বহাল করা হয়,” একথা আজও মনে রেখেছেন দামিনী। অগস্ট ২০২০-এ পুনরায় পুলিশের কাজে ফেরেন তিনি।

আজ তিনি মারাঠওয়াড়ার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় থাকেন। তাঁর ভিটে আর খানকতক খামারবাড়ি বাদে জনবসতির চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। আশপাশে লোকজনও নেই তেমন।

PHOTO • Jyoti Shinoli

যদ্দূর মনে পড়ে, দামিনী বরাবরই বরিষ্ঠ সরকারি আধিকারিক হতে চেয়েছিলেন, যাতে বেকারত্বে জর্জরিত এই অঞ্চলে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়

“এখানে সুরক্ষিত বোধ করি। জনাকয় চাষি বাদে এদিকটায় কেউ আসে না,” গলা শুনে মনে হল বেশ স্বস্তিতেই আছেন দামিনী, কোলে দ্বিতীয়পক্ষের বিবাহজাত ছ'মাসের নবজাতক। “আগে আগে সারাক্ষণ উদ্বেগে কাটত, কিন্তু মেয়েটা জন্মাবার পর থেকে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।” স্বামীর সহায় পেয়েছেন দামিনী। ছোট্ট কন্যাসন্তানটি হওয়ার পর থেকে বাপের সঙ্গে বিগড়ে যাওয়া সম্পর্কটাও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।

দামিনীর অভিযোগ অনুসারে যে থানায় তাঁর ধর্ষণ হয়েছিল, সেখানে তিনি আর কাজ করেন না। তার বদলে ওই একই জেলার অন্য একটি পুলিশ স্টেশনে প্রধান কনস্টেবলের পদে তিনি কর্মরত। দামিনী যে যৌন নির্যাতনের ভুক্তভোগী, সেটা তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাদে মোটে দু'জন সহকর্মী জানেন। অধুনা বা প্রাক্তন কর্মস্থলের কেউই জানে না তিনি থাকেন কোথায়। এতকিছু সত্ত্বেও দামিনী প্রকৃত অর্থে সুরক্ষিত বোধ করেন না।

“আমি যদি বাইরে যাই, আর গায়ে উর্দি না থাকে, একটুকরো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখি। একা একা কক্ষনো বাইরে পা রাখি না। সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করে চলি। ওরা যেন কোনওদিন আমার ঘর অবধি না আসতে পারে,” দামিনী বলে উঠলেন।

ভয়টা কিন্তু আদৌ অমূলক নয়।

দামিনীর অভিযোগ, সেই সিভিক ভলেন্টিয়ারটি হামেশাই তাঁর নতুন কর্মস্থলে এসে হাজির হয়, এমনকি তিনি কোনও পুলিশ চেকপয়েন্টে মোতায়েন থাকলে সেখানেও দেখা দেয় আর মারধর করতে ছাড়ে না। “একবার তো একটা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে আমায় পিটিয়েছিল, যেদিন জেলা আদালতে আমার মামলাটার শুনানির তারিখ ছিল।” সদ্য সদ্য মা হওয়ার দরুণ মেয়ের সুরক্ষাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। মেয়েকে সজোরে আঁকড়ে ধরে তিনি প্রশ্ন করলেন, “ওরা যদি আমার মেয়েটার কিছু করে দেয়?” জবাবটা অবশ্য সওয়ালের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।

এই প্রতিবেদক ২০২৪ সালের মে মাসে দেখা করেন দামিনীর সঙ্গে। মারাঠওয়াড়ার নিদারুণ দাবদাহ, বিচারের তরে প্রায় সাত বছর ব্যাপী সংগ্রাম, মুখ খোলার পর থেকে পিছু না-ছাড়তে-চাওয়া আতঙ্ক, সমস্ত কিছু সয়ে তাঁর জেদ আজ তুঙ্গে, তাঁর সংকল্প অটুট। “আমি চাই অভিযুক্তদের প্রত্যেকেই জেলে ঘানি টানুক। মলা লড়াইয়চ আহে (আমি লড়ে যেতে চাই)।”

ভারতে যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক হিংসার শিকার মানুষদের সঠিক যত্ন ও সুস্থতার ক্ষেত্রে সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত যেসব বাধা আসে সে বিষয়ে সর্বভারতীয় একটি সাংবাদিকতা প্রকল্পের অংশ এই প্রতিবেদনটি। ডক্টরস্‌ উইদাউট বর্ডারস-এর ভারত অধ্যায় দ্বারা সমর্থিত একটি উদ্যোগের অঙ্গ।

ভুক্তভোগী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের পরিচয় গোপন রাখতে নাম পরিবর্তিত করা হয়েছে।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Jyoti Shinoli is a Senior Reporter at the People’s Archive of Rural India; she has previously worked with news channels like ‘Mi Marathi’ and ‘Maharashtra1’.

Other stories by Jyoti Shinoli
Editor : Pallavi Prasad

Pallavi Prasad is a Mumbai-based independent journalist, a Young India Fellow and a graduate in English Literature from Lady Shri Ram College. She writes on gender, culture and health.

Other stories by Pallavi Prasad
Series Editor : Anubha Bhonsle

Anubha Bhonsle is a 2015 PARI fellow, an independent journalist, an ICFJ Knight Fellow, and the author of 'Mother, Where’s My Country?', a book about the troubled history of Manipur and the impact of the Armed Forces Special Powers Act.

Other stories by Anubha Bhonsle
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra