কুনোর চিতাদের নিয়ে যে কোনও তথ্য আজকাল জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপার, তার লঙ্ঘন হলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

অন্যভাবে বললে, মধ্যপ্রদেশ সরকার এই কারণটাই দেখিয়েছে ২০২৪-এর জুলাই মাসে চিতাদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে একটি আরটিআই বা তথ্যের অধিকার আইনের অধীনস্থ জিজ্ঞাসা বাতিল করার সময়ে। আরটিআই-টি যিনি দাখিল করেছিলেন সেই ভোপালনিবাসী আন্দোলনকর্মী অজয় দুবে বলছেন, “বাঘের বেলায় সমস্ত তথ্য স্বচ্ছ, তাহলে চিতাদের বেলায় কেন নয়? বন্যপ্রাণ রক্ষণাবেক্ষণের একদম প্রাথমিক নিয়ম হল তথ্যের স্বচ্ছতা।”

কুনো অভয়ারণ্য-সংলগ্ন আগারা গ্রামের বাসিন্দা রামগোপাল অবশ্য জানেনই না যে তাঁর জীবন-জীবিকার ধারা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বা কূটনৈতিক সম্পর্কে এমন প্রভাব ফেলছে। তাঁর ও তাঁর মতো হাজারো আদিবাসীদের দুশ্চিন্তার অন্য অনেক কারণ রয়েছে।

সম্প্রতি বলদ ছেড়ে ট্র্যাক্টর নিয়েছেন তিনি। হঠাৎ করে মেশিন কেনার মতো বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন বলে নয় কিন্তু। বরং উল্টোটাই।

“মোদীজি আমাদের আদেশ করেছিলেন। বলেছিলেন আমাদের গরু-বলদ যেন আমরা ছেড়ে না দিই। কিন্তু চরানোর জায়গা তো শুধু জঙ্গলে [কুনো] আর জঙ্গলে ঢুকলে রেঞ্জাররা আমাদের ধরে জেলে পুরে দেবে। তাই ভাবলাম, বরং ট্র্যাক্টরই ভাড়া করে নিই।”

রামগোপালের পরিবারের এই খরচা চালানোর সামর্থ্য নেই। তাঁদের সবার রোজগার মিলিয়েও দারিদ্র্যসীমার বেশ কিছুটা নিচেই থেকে যায়। কুনো অভয়ারণ্য চিতাদের খাসমহল হয়ে ওঠার জেরে তাঁদের জঙ্গল-ভিত্তিক আয়ের পথগুলি একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

এলাকার মানুষদের জন্য জলের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল কুনো নদী। কিন্তু বাকি জঙ্গলের মতো নদীও এখন নিষিদ্ধ এলাকা। সেহেরিয়া আদিবাসীরা শুধু বাফার জোনে ঢোকেন দারুবৃক্ষ ছাড়া অন্যান্য বনজ সামগ্রী সংগ্রহ করতে

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: সন্তু আর রামগোপাল বিজয়পুর তেহসিলের আগারা গ্রামের বাসিন্দা, জীবনধারণের জন্য জঙ্গলের চির গঁদ গাছগুলি থেকে প্রাপ্ত দারুবৃক্ষ ছাড়া অন্যান্য বনজ সামগ্রীর উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্ত এখন সেই গাছপালা পড়ছে নিষিদ্ধ এলাকার ভিতরে। ডানদিকে: স্কুল ছেড়ে দিয়েছে তাঁদের ছেলে হংসরাজ, এখন মজুরির কাজ নিয়ে দেশান্তরে পাড়ি জমাবে বলে পরিকল্পনা করেছে

এই অভয়ারণ্য এলাকা সর্বভারতীয় আলোকবর্তিকায় এসে পড়ে ২০২২ সালে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আফ্রিকান চিতাদের (অ্যাসিনোনিক্স জুবাটুস) এখানে নিয়ে আসা হয়। সবকটি বৃহৎ মার্জার প্রজাতির বাসস্থল পৃথিবীর একমাত্র দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি স্থাপন করা ছিল উদ্দেশ্য। চিতাদের তিনি ভারতে স্বাগত জানান তাঁর নিজের জন্মদিনে।

আশ্চর্যজনকভাবে, আমাদের জাতীয় বন্যপ্রাণ কর্মপরিকল্পনা ২০১৭-২০৩১ নামক যে নথিতে দেশি এবং চূড়ান্ত বিপন্ন প্রজাতি যেমন গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড পাখি, গাঙ্গেয় শুশুক এবং তিব্বতি অ্যান্টিলোপদের সংরক্ষণের পদ্ধতি একদম ধাপে ধাপে বিধৃত আছে, তার কোথাও চিতা পুনর্বাসনের কোনও উল্লেখ নেই। বস্তুত ২০১৩ সালে চিতা নিয়ে আসার পরিকল্পনা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট, এই বিষয়ে একটি ‘পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা’ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

তা সত্ত্বেও কয়েকশো কোটি টাকা ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে চিতাদের নিয়ে আসা, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং সেই সম্পর্কিত প্রচারে।

রামগোপালের মতো সেহেরিয়া আদিবাসীরা জীবনধারণের জন্য মূলত নির্ভর করেন জঙ্গল থেকে সংগৃহীত দারুবৃক্ষ-ব্যতীত অন্যান্য বনজ সম্পদ (নন টিম্বার ফরেস্ট প্রোডিউস) অর্থাৎ ফল, শিকড়বাকড়, রেসিন এবং জ্বালানি কাঠকুটো ইত্যাদির উপর। কুনো চিতা সাফারি হয়ে গিয়ে ধ্বংস হতে বসেছে তাঁদের জীবন-জীবিকার সেই ধারা। ১২৩৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত কুনো বন্যপ্রাণ ডিভিশনের ভিতরে বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে আছে এই কুনো জাতীয় উদ্যান।

“সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, টানা ১২ ঘণ্টা ধরে আমি অন্তত আমার ৫০টা গাছে কাজ করতাম, চারদিন পর ফিরতাম জমা হওয়া রেসিন সংগ্রহ করার জন্য। শুধু আমার চির গাছগুলো থেকেই মাসে ১০,০০০ টাকা আসত,” জানাচ্ছেন রামগোপাল। সেই ১২০০টি মহামূল্যবান চির গঁদ গাছ এখন স্থানীয় মানুষের নাগালের বাইরে। অভয়ারণ্য যেদিন থেকে চিতা প্রকল্প হয়ে গেছে, সেদিন থেকে গাছগুলো চলে গেছে নতুন বাফার জোনের ওপারে।

রামগোপাল ও তাঁর স্ত্রী সন্তু দুজনেরই বয়স তিরিশের কোঠায়। কুনো অভয়ারণ্যের গা-ঘেঁষা কয় বিঘা বর্ষাপুষ্ট জমিতে কিছু চাষবাস করেন, মূলত নিজেদের খোরাকির জন্য। “বাজরা ফলাই খাওয়ার জন্য, আর তিল আর সরষে কিছুটা বিক্রি করি,” জানালেন রামগোপাল। বীজরোপণের সময় এই জমিতে কাজের জন্যই তাঁকে ট্র্যাক্টর ভাড়া নিতে হয়েছে।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: রামগোপাল দেখাচ্ছেন রেসিন তোলার জন্য কীভাবে চির গাছের গায়ে ছিদ্র করতে হয়। ডানদিকে: একটা হ্রদের খাতে দাঁড়িয়ে একটু বিরাম নিচ্ছেন দম্পতি। পাশেই কুনো অরণ্য, যার ভিতরে তাঁদের গাছগুলো এখন তাঁদেরই নাগালের বাইরে

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: কুনো অভয়ারণ্যের গা-ঘেঁষা কয় বিঘা বর্ষাপুষ্ট জমিতে কিছু চাষবাস করেন রামগোপাল ও তাঁর স্ত্রী সন্তু, মূলত নিজেদের খোরাকির জন্য। ডানদিকে: বনজ সম্পদের অভাব টের পাচ্ছেন আগারার ব্যবসায়ীরাও

“জঙ্গল ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই। জমিতে পর্যাপ্ত জল পর্যন্ত নেই। এখন জঙ্গল বন্ধ করে দিয়েছে, তাই [কাজের খোঁজে] বিভুঁই যেতে হবে,” বলছেন তিনি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বন দপ্তরের তরফে তেন্দু পাতা কেনায় আচমকা পড়তি। সারা বছরই রাজ্যের তরফে নিয়মিত তেন্দুপাতা কেনা হত, যা আদিবাসীদের জন্য নিশ্চিত রোজগারের একটা পথ ছিল। এখন ক্রয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ায় টান পড়েছে রামগোপালের রোজগারেও।

গোটা মধ্যপ্রদেশেই জঙ্গল এবং জঙ্গল-সংলগ্ন এলাকার মানুষের কাছে দারুবৃক্ষ-ব্যতীত বনজ সম্পদ প্রাণভোমরা-স্বরূপ। এদের মধ্যে প্রধান হল চির গাছের গঁদ বা রেসিন – চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য আর আষাঢ় অর্থাৎ মোটামুটি মার্চ থেকে জুলাই মাসের সময়কাল বাদ দিয়ে বাকি বছর জুড়ে যার সংগ্রহ চলে। কুনো অভয়ারণ্যের ভিতরে ও আশপাশে বসবাসকারী অধিকাংশই সেহেরিয়া আদিবাসী, রাজ্যে ‘অতিবিপন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে নথিভুক্ত এক জনগোষ্ঠী, যাঁদের ৯৮ শতাংশই রুজিরুটির জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল, জানাচ্ছে ২০২২ সালের এই রিপোর্ট

স্থানীয় মানুষদের কাছে আগারা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র, তাঁরা এখানে বনজ সম্পদ এনে বিক্রি করেন রাজু তিওয়ারির মতো ব্যবসায়ীদের কাছে। তিওয়ারি জানাচ্ছেন, জঙ্গল বন্ধ হওয়ার আগে শত শত কিলো রেসিন আর শিকড়বাকড় আসত এই বাজারে।

“আদিবাসীরা জঙ্গলের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন, আর আমরা আদিবাসীদের সঙ্গে জুড়ে ছিলাম,” ব্যাপারটা এভাবেই দেখেন তিনি। “এখন জঙ্গলের সঙ্গে ওঁদের যোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে, আর তার ধাক্কা এসে আমাদের সবার গায়ে লাগছে।”

ছিন্নমূল মানুষ: কুনো অরণ্য তবে কার?

গোটা মধ্যপ্রদেশেই জঙ্গল এবং জঙ্গল-সংলগ্ন এলাকার মানুষের কাছে গঁদ বা রেসিনের মতো ‘দারুবৃক্ষ-ব্যতীত বনজ সম্পদ’ বা এনটিএফপি প্রাণভোমরা-স্বরূপ

*****

জানুয়ারির এক হিমশীতল ভোরে একখানা দা আর কয়েক মিটার পাকানো দড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন রামগোপাল। আগারায় তাঁর বাড়ি থেকে কুনো অভয়ারণ্যের পাথরের পাঁচিলটার দূরত্ব তিন কিলোমিটার, যে পথটা প্রায়শই পাড়ি দেন তিনি। আজ তিনি ও তাঁর স্ত্রী যাচ্ছেন জ্বালানি কাঠ কুড়াতে; দড়িটা বান্ডিল বাঁধার জন্য।

স্ত্রী সন্তুর মাথায় দুশ্চিন্তা ঘুরছে, জ্বালানি আদৌ পাওয়া যাবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বললেন, “মাঝে মাঝে ওরা [বন দপ্তরের কর্মীরা] ভিতরে ঢুকতে দেয় না। হয়তো গিয়ে ফিরে আসতে হবে।” গ্যাস কানেকশন নেওয়ার সামর্থ্য আজ অবধি হয়নি তাঁদের।

“পুরোনো গ্রামে [অভয়ারণ্যের ভিতরে] কুনো নদীটা ছিল, তাই ১২ মাস আমরা জল পেতাম। তেন্দু, বেড়, মহুয়া, জড়িবুটি, জ্বালানি সব পেতাম…” হাঁটতে হাঁটতে যোগ করেন সন্তু।

কুনো অরণ্যের ভিতরেই পিতামাতার কোলেপিঠে বড়ো হয়েছেন সন্তু, তাঁদের সঙ্গেই উৎখাতও হয়েছেন পুরোনো গ্রাম থেকে – ১৯৯৯ সালে এশীয় সিংহদের জন্য দ্বিতীয় বাসস্থান হিসেবে জায়গা করতে যে ১৬,৫০০ জন্য কুনোর অরণ্যবাসীকে উৎখাত করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সন্তুরাও ছিলেন। পৃথিবীর একমাত্র এশীয় সিংহ গোষ্ঠীটি এই মুহূর্তে  আছে গুজরাটের গির অরণ্যে। পড়ুন: কুনো অভয়ারণ্য: পড়ে রইল বঞ্চনার সিংহভাগ

“সামনে আরও পরিবর্তন আসছে। জঙ্গল মে যানা হি নেহি [জঙ্গলে আর যাওয়াই যাবে না],” বলছেন রামগোপাল।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

‘পুরোনো গ্রামে [অভয়ারণ্যের ভিতরে] কুনো নদীটা ছিল, তাই ১২ মাস আমরা জল পেতাম। তেন্দু, বেড়, মহুয়া, জড়িবুটি, জ্বালানি সব পেতাম…’ বলছেন সন্তু। জ্বালানি কাঠ আনতে কুনো অরণ্যের দিকে পাড়ি দিয়েছেন দম্পতি

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

জঙ্গলের ভিতর জ্বালানি কাঠ কুড়োচ্ছেন রামগোপাল ও তাঁর স্ত্রী। জানালেন, গ্যাস সিলিন্ডার কেনার পয়সা নেই তাঁদের

অরণ্যের অধিকার আইন ২০০৬ মতে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুমতি ছাড়া জমি ছিনিয়ে নেওয়ার কোনও অধিকার নেই রাষ্ট্রের। কিন্তু চিতাদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বলবৎ হয়ে গিয়েছে বন্যপ্রাণ (সংরক্ষণ) আইন ১৯৭২ , যেখানে বলা হচ্ছে, সরকার “... এমন রাস্তা, সেতু, ভবন, বেড়া বা পাঁচিল নির্মাণ করবে [যা]... খ) অভয়ারণ্য এবং অভয়ারণ্যের ভিতরে বসবাসকারী বন্যপ্রাণীদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় নিশ্চিত করবে।”

প্রথম যখন পাঁচিল তৈরির কথা শোনেন রামগোপাল, “আমায় বলা হয়েছিল ওটা একটা খামারের জন্য হচ্ছে, তো আমরা ভেবেছিলাম তাহলে ঠিক আছে,” মনে করেন তিনি। “কিন্তু তিন বছর বাদে ওরা বলল, ‘এখন থেকে আর তোমরা ঢুকতে পারবে না। পাঁচিলের ওপারে আর যেতে পারবে না। তোমাদের গবাদি পশু যদি ভিতরে চলে আসে তবে জরিমানা দিতে হবে, নয়তো জেলে যাবে’,” সংযোজন তাঁর। “যদি ঢুকি, তো ২০ বছরের জেল [আমাদের বলা হয়েছিল]। আমার [জামিন নেওয়ার] অত পয়সা নেই,” হাসতে হাসতে যোগ করেন তিনি।

পশুচারণের অধিকার চলে যাওয়ায় কমে গেছে গবাদি পশুর সংখ্যাও, আর স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন পশু মেলা বা হাট এখন অতীতের গর্ভে। ১৯৯৯ সালে উৎখাত হওয়ার সময়ে বহু মানুষ নিজেদের গরু-ছাগল জঙ্গলেই ছেড়ে রেখে এসেছিলেন, জঙ্গল থেকে দূরে নতুন জায়গায় কোথায় কীভাবে পশু চরাবেন তার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। আজও জঙ্গলের বাফার জোনে গরু-বলদ ঘুরে বেড়ায়, তাদের অনেককেই এভাবে মালিকরা ছেড়ে এসেছেন। আছে বুনো কুকুররা গবাদি পশুদের আক্রমণ করবে সেই ভয়ও। রেঞ্জাররা সতর্ক করে রেখেছেন, [তোমরা বা তোমাদের গবাদি পশু জঙ্গলে গেলে] ওরা ঠিক খুঁজে খুঁজে এসে মেরে দিয়ে যাবে।”

কিন্তু জ্বালানির অভাব এতটাই চরম যে “চোরি-চুপকে” বা চুপসাড়ে এখনও অনেকে জঙ্গলে যান। আগারার বাসিন্দা সাগু যেমন মাথায় চাপিয়ে কাপড়ে জড়ানো পাতা-কাঠির ছোট একটা বান্ডিল নিয়ে ফিরছেন – ষাটের কোঠায় এসে এখন এর বেশি ভার বইতে পারেন না।

“জঙ্গল মে না যানে দে রহে [জঙ্গলে আর যেতে দিচ্ছে না],” প্রশ্ন করায় একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে গুছিয়ে বসলেন তিনি। “মহিষ যে কটা আছে সব বেচে দিতে হবে।”

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

জঙ্গল-ঘেরা পাঁচিলের সামনে রামগোপাল। একদা ৩৫০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট অভয়ারণ্য কুনো আফ্রিকান চিতাদের স্বাগতকল্পে আকারে দ্বিগুণ হয়ে গেছে

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: বাড়ির প্রয়োজন মেটাতে আগারার বাসিন্দা ৬০ বছরের সাগু এখনও জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। ডানদিকে: কাশিরামও যেতেন বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে, কিন্তু জানাচ্ছেন এখন জঙ্গল পুরোপুরি বন্ধ

সাগু জানাচ্ছেন, আগে তাঁরা ঠেলায় করে করে জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসতেন, বর্ষাকালের জন্য জমিয়ে রাখতেন। এককালে তাঁদের গোটা বাড়িটাই এই জঙ্গলের কাঠ-পাতা দিয়ে তৈরি ছিল, মনে পড়ে তাঁর। “আমাদের গরু-বলদ চরত, আর আমরা জ্বালানি, পশুদের ঘাসবিচালি, বিক্রি করার জন্য তেন্দুপাতা এইসব তুলতাম।”

শত শত বর্গকিলোমিটার জমি এখন শুধু চিতাদের, আর তাদের দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য সীমাবদ্ধ।

আগারা গ্রামে সব হারিয়েছেন যাঁরা তাঁদেরই প্রতিধ্বনি যেন কাশিরামের গলায়, “চিতারা এসে [আমাদের] কোনও ভালো হয়নি। শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি।”

*****

চেন্টিখেডা, পাদরি, পাইরা-বি, খাজুরি খুর্দ আর চাকপারন জাতীয় গাঁগুলির সমস্যা আরও বড়ো। তাঁরা জানাচ্ছেন, জমি জরিপ করে কুয়ারি নদীর উপর একটা বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে যা তাঁদের জমিবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

“গত ২০ বছর ধরে বাঁধের কথা শুনে যাচ্ছি। অফিসাররা বলে, ‘তোমাদের গ্রাম তো বাঁধের জন্য উঠে যাবে, তাই তোমরা নারেগার কাজ পাবে না’,” জানালেন জসরাম আদিবাসী। চেন্টিখেডার প্রাক্তন গ্রামপ্রধান জানাচ্ছেন, এই করে করে বহু মানুষের নারেগা-র প্রাপ্য আটকে দেওয়া হয়েছে।

অদূরে দেখা যায় কুয়ারি নদী, বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন, “বাঁধের জল এসে এই সব এলাকা ডুবিয়ে দেবে। আমাদের গ্রাম, আরও ৭-৮টা গ্রাম ডুববে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও নোটিস আসেনি।”

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

জসরাম আদিবাসী চেন্টিখেডা গ্রামের প্রাক্তন গ্রামপ্রধান, কুয়ারি নদীর বাঁধের জলে ডুবে যেতে বসেছে যে গ্রাম। এখানে স্ত্রী মাসলা আদিবাসীর সঙ্গে জসরাম

PHOTO • Priti David

কুয়ারি নদীর উপর বাঁধের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। চারটি গ্রাম এবং কয়েকশো পরিবারকে উৎখাত করতে চলেছে এই প্রকল্প

জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পুনর্প্রতিষ্ঠায় ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও স্বচ্ছতার অধিকার আইন , ২০১৩ অনুসারে এই মাপের উৎখাত প্রক্রিয়া শুরুর আগে গ্রামের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে তা একেবারে ধাপে-ধাপে বুঝিয়ে দেওয়া আছে – এবং যা এখানে অনুসরণ করা হয়নি। এই সমীক্ষা এবং আলোচনার সব তারিখ স্থানীয় ভাষায় (সিএইচ II এ ৪ (১)) ঘোষণা করতে হবে, সবাই যাতে আসে তার জন্য নোটিস দিতে হবে, আছে এইসব নিয়মও।

“২৩ বছর আগে উৎখাত হয়েছিলাম। বহু কষ্টে আবার নতুন করে জীবন গড়ে তুলেছি,” বলছেন চাকপড়া গ্রামের সৎনাম আদিবাসী। জয়পুর, গুজরাট এবং অন্য নানা জায়গায় প্রায়শই মজুরিভিত্তিক কাজের খোঁজে পাড়ি দেন তিনি।

বাঁধের কথাটা সৎনাম জানতে পারেন গ্রামের একটা ওয়াটস্‌অ্যাপ গ্রুপে ঘুরতে থাকা খবর মারফত। “আমাদের কেউ কিছু বলেনি, আমরা জানিও না কে বা কতজন জলের তলায় চলে যাবে,” যোগ করেন তিনি। এদিকে রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিকরা এসে কোন বাড়ি কাঁচা, কোন বাড়ি পাকা, কতখানি জমি নিয়ে আছে ইত্যাদি তথ্য লিখে নিয়ে গেছেন।

গত উচ্ছেদের স্মৃতি এখনও টাটকা তাঁর বাবা সুজনসিং-এর স্মৃতিতে, এবার আবার উৎখাত হতে চলেছেন তিনি। “হামারে উপর ডাবল কষ্ট্‌ হো রহা হ্যায় [আমাদের তো দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে]।”

অনুবাদ : দ্যুতি মুখার্জী

Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. She writes on forests, Adivasis and livelihoods. Priti also leads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum.

Other stories by Priti David

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Video Editor : Sinchita Parbat

Sinchita Parbat is a Senior Video Editor at the People’s Archive of Rural India, and a freelance photographer and documentary filmmaker. Her earlier stories were under the byline Sinchita Maji.

Other stories by Sinchita Parbat
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

Other stories by Dyuti Mukherjee